1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আবার বছর কুড়ি পরে, স্বর্ণ শহর থেকে সবরমতীর তীরে

সামীউর রহমান
১৯ নভেম্বর ২০২৩

জোহানেসবার্গ ২০০৩ থেকে আহমেদাবাদ ২০২৩। আরো একবার ৫০ ওভারের ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি ভারত-অস্ট্রেলিয়া। মাসদেড়েক ধরে চলা ১০ দলের ৪৮ ম্যাচের লড়াইয়ের চূড়ান্ত ফয়সালার অপেক্ষা এখন।

https://p.dw.com/p/4Z5M5
বিশ্বকাপ ২০২৩ ফাইনালে মুখোমুখি হওয়ার আগে ৮ অক্টোবর চেন্নাইয়ের এমএ চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়াকে ৬ উইকেটে হারিয়েছিল ভারত।
বিশ্বকাপ ২০২৩ ফাইনালে মুখোমুখি হওয়ার আগে ৮ অক্টোবর চেন্নাইয়ের এমএ চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়াকে ৬ উইকেটে হারিয়েছিল ভারত।ছবি: ADNAN ABIDI/REUTERS

সোনার শহর জোহানেসবার্গ আর সবরমতীর তীরের আহমেদাবাদ, ২০ বছর আগে-পরে দুটো বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হওয়ার বাইরে একজন মানুষই দুটো শহরকে এক করতে পারেন। তার নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। গুজরাতের হিন্দু বণিক পরিবারের সন্তান মোহনদাস তখনও 'মহাত্মা' হননি, বিলেত থেকে পাস করা তরুণ ব্যারিস্টার হিসেবে আবদুল্লাহ নামের এক মক্কেলের কেস লড়তে এসেছেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। জোহানেসবার্গের আদালতের সামনে ভারতের জাতির পিতার যে ভাষ্কর্য, সেখানে অবশ্য মহাত্মা  উকিলের পোষাক পরা তরুণ এক আইনজীবী। আহমেদাবাদ শহরের কেন্দ্র থেকে মাইলচারেক দূরে সবরমতী আশ্রমে স্থাপিত ভাষ্কর্যটি অবশ্য 'মহাত্মা'র। চশমা চোখে, খদ্দর গায়ে যে চেনা রূপটি আমাদের মানসচক্ষে ভেসে ওঠে। জেলবন্দি না হলে, কিংবা ভারতবর্ষ পরিভ্রমণে বের না হলে এই আশ্রমেই বাস করতেন গান্ধী। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সত্যাগ্রহ আন্দোলনের শুরু এখানেই।

একজন তরুণ আইনজীবি , যে নিজেকে 'আগে একজন ব্রিটিশ প্রজা এবং পরে ভারতীয়' ভাবতেন তাঁরই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদী কন্ঠস্বর হয়ে ওঠার যাত্রাটা যেমন বিষ্ময়কর, তেমনি বিষ্ময়কর ২০০৩ থেকে ২০২৩ সালে এসে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া দুই দলের অবস্থানের পরিবর্তন। রোহিত শর্মার এই দলটা যেন ২০০৩-এর রিকি পন্টিং-এর সেই দলটার মতোই অকুতোভয় আর অদম্য। আর প্যাট কামিন্সের দলটা সেদিনের সৌরভ গাঙ্গুলির ভারতের মতোই, ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের ঝলক আছে কিন্তু দল হয়ে ওঠাটা হচ্ছে না। মার্ক টোয়েনের 'দ্য প্রিন্স অ্যান্ড দ্য পপার'-এর মতোই রাজপুত্র এবং রাস্তার ছেলের এই অদল-বদল সম্ভব হয়েছে যে জাদুমন্ত্রের জোরে, তার নাম ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ

সভ্যতার ইতিহাসে আগুন আবিষ্কারের আগে এবং পরের মতো করে ক্রিকেটের ইতিহাসের 'আইপিএল-পূর্ব' এবং 'আইপিএল-পরবর্তী' বলে অদৃশ্য অথচ সুস্পষ্ট একটা লক্ষণরেখা টানা আছে। ২০০৮ সাল থেকে চলে আসা ক্রিকেটের এই বার্ষিক আয়োজন বদলে দিয়েছে ক্রিকেটারদের মনোজগত। বিশেষ করে ভারতীয় ক্রিকেটারদের। ২০০৩ সালের দিনেশ মোঙ্গিয়া, মুনাফ প্যাটেলদের কাছে রিকি পন্টিং, অ্যাডাম গিলক্রিস্টরা ছিলেন দূর আকাশের তারা। শেন ওয়ার্ন, ব্রেট লিরা ম্যাচ শুরুর আগেই মনস্তাত্বিক লড়াইয়ে কোণঠাসা করে রাখতেন প্রতিপক্ষকে। এখন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল বিয়ে করেন ভারতীয় রীতিতে, তাতে বরের বন্ধু বেশে নাচে যোগ দেন বিরাট কোহলি। ডেভিড ওয়ার্নার তার তিন কন্যা আর স্ত্রীকে নিয়ে 'পুষ্পা' ছবির গানে নেচে ভিডিও দেন ইনস্টাগ্রামে, সেঞ্চুরি করে উদযাপন করেন দক্ষিণী ছবির নায়ক অল্লু অর্জুনের স্টাইলে। হরভজন সিং আর অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস মাঠেই অশ্রাব্য গালাগাল দিয়েছিলেন একে অন্যকে,এইসময়ে প্যাট কামিন্স এবং শ্রেয়শ আইয়ার এমনটা করার কথা ভাবতেও পারবেন না। প্রতিবছর নিয়ম করে আইপিএলের মাসদুয়েক একই দলের হয়ে খেলা, একসঙ্গে থাকা এবং ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতাগুলো ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের এতটাই কাছাকাছি করেছে যে, কোন জার্সিতে কে কখন সতীর্থ আর কে প্রতিপক্ষ সেসব অনেকেরই গুলিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত তারকাদের সঙ্গে খেলতে খেলতে আর চাপের মুখে মাঠে নামতে নামতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রায় কাছাকাছি অভিজ্ঞতা জাতীয় দলে অভিষেকের আগেই হয়ে যাচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেটারদের। একসময় যেটা শেফিল্ড শিল্ড আর জিলেট কাপ খেলে খেলে হয়ে যেতো অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের। তাই তো জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নেমে প্রথম বলেই ছয় মেরে দেবার দুঃসাহস দেখাতে পারেন সূর্যকুমার যাদব।

এই আইপিএল সাম্রাজ্যের সম্রাটের নাম রোহিত শর্মা। তার নেতৃত্বে ৫ বার শিরোপা জিতেছে মুম্বাই ইন্ডিয়ানস। ২০১৭ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে ভারতের অধিনায়কের দায়িত্ব নেবার পর ৪৪ ম্যাচে ৪টা সেঞ্চুরি আর ১৪টা হাফসেঞ্চুরি। তার নেতৃত্বে ৪৪ ম্যাচের ৩৪টিতেই জিতেছে ভারত, ২০১৮ এবং ২০২৩ এর এশিয়া কাপও আছে রোহিতের পকেটে। তার নেতৃত্বে বিশ্বকাপে অশ্বমেধের নীলঘোড়া হয়ে ছুটছে নীল জার্সির ভারত। ১০ ম্যাচের ১০টিই তারা জিতেছে। শুধু ম্যাচই জেতেনি, প্রতিপক্ষের মনোবল গুঁড়িয়ে দিয়ে জিতেছে। বিশ্বকাপে চারশ রানের কাছাকাছি তোলাটা যারা দস্তুর বানিয়ে ফেলেছিল, সেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে ভারত অলআউট করেছে মাত্র ৮৩ রানে। প্রথম চার ম্যাচে একাদশেই জায়গা হচ্ছিল না মোহাম্মদ শামী'র। হার্দিক পান্ডিয়ার চোটে দলে ঢুকে ৬ ম্যাচ খেলে ২৩ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী, সেরা বোলিং নৈপুণ্যের অধিকারী।

২০০৩ বিশ্বকাপে কোনো ম্যাচ হারেনি অস্ট্রেলিয়া। দুটো ম্যাচে খানিকটা চাপের মুখে পড়েছিল, বিখ্যাত 'হলুদ জার্সি' তখন খেলোয়াড়ের ভেতর থেকে বের করে এনেছিল সেই হার না মানা মনোভাব। এর জোরে আফগানদের বিপক্ষে শেষ পর্যন্ত লড়াইটা চালিয়ে গেছেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। নীলজার্সি গায়ে বিরাট কোহলি, লোকেশ রাহুল, শ্রেয়শ আইয়ারদের চোখেমুখে সেই একই আত্মবিশ্বাসের ঝিলিক, সেই একই চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা। আর সাড়ে পাঁচশ রান করে ফেলা রোহিতকে মনে হচ্ছে ২০০৩-এর পন্টিং, যে মানুষটা জোহানেসবার্গের ফাইনালটায় ১৪০* রানের ইনিংস খেলে একাই হারিয়ে দিয়েছিলেন ভারতকে।

উল্টোদিকে কামিন্স যেন ২০০৩-এর সৌরভ। জানেন হাতে মশলা আছে, কিন্তু ঠিক আগুনটা নেই। নিজের পারফরম্যান্স নিয়েও সন্দিহান। রানের অংকে ২০০৩ বিশ্বকাপে সৌরভের রান ৪৬৫, ৩টি সেঞ্চুরি। কিন্তু সে তিনটের দুটো কেনিয়ার বিপক্ষে, একটা নামিবিয়ার বিপক্ষে। কামিন্সও জানেন এবারের বিশ্বকাপে তার পারফরম্যান্স আসলে ১৩টা উইকেট নয়, ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেই ৬৮ বলে ১২ রানের ইনিংসটা। সৌরভ জানতেন, শচীন-শেবাগ ফেল করলে বাঁচানোর কেউ নেই; দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটে শেষবেলার জাভাগাল শ্রীনাথ আর নিয়ন্ত্রনহীন জহির খানদের দিয়ে ফাইনালে কাজ হবে না। হয়নি। শ্রীনাথ দিয়েছিলেন ১০ ওভারে ৮৭, জহিরও নিজেকে খুঁজে না পাওয়ায় ৭ ওভারেই দিয়েছিলেন ৬৭, মূল্যস্ফীতির অংকে হিসাব করলে ২০ বছর আগের এই রানটা আজকের দিনে একশ'র ওপরে হবে হেসে-খেলে। ফাইনালে ভারতের তিন পেসার মিলে একটাও উইকেট তুলতে পারেননি।

 বৃহস্পতিবার কামিন্স নিশ্চয়ই দেখেছেন মাত্র ২১২ রানে গুটিয়ে যাওয়া ম্যাচেও লেগস্পিনার অ্যাডাম জাম্পার ৭ ওভারে ৫৫ রান নিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। আধডজন ছয় হয়েছে জাম্পার বলে, মিলারই মেরেছেন চারখানা। চেন্নাইতে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে ভারতের ব্যাটসম্যানরা জাম্পার ৮ ওভারে নিয়েছিলেন ৫৩ রান, উইকেট দেননি। অস্ট্রেলিয়ার পঞ্চম বোলার নেই; ম্যাক্সওয়েল, ট্র্যাভিস হেড আর মিচেল মার্শ মিলে সেই জায়গাটা পূরণ করেন। উইকেটরক্ষক জশ ইংলেসের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোনো সেঞ্চুরি নেই, ১৭ ওয়ানডের ক্যারিয়ারে তিনি যত রান করেছেন, এই বিশ্বকাপে লোকেশ রাহুল ৯ ইনিংসে করেছেন তারচেয়ে বেশি রান। এই পার্থক্যগুলো ঘুচিয়ে ফেলার জন্য শুক্রবার আর শনিবার, মাত্র দুটো দিন আছে কামিন্সের হাতে।

রবিবারের ফাইনালে, ১ লক্ষ ৩০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে নিঃসন্দেহে স্বাগতিক ভারতই এগিয়ে থাকবে। তবে বিশ্বকাপের বাকি ৯ দলের ভেতর যোগ্যতম প্রতিদ্বন্দীকেই ফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েছে ভারত। ঐতিহ্য, আধুনিকতা, পেশাদারী এবং ক্রিকেটের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল দুটো দলই লড়বে শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড থাকতেই পারতো এবারের ফাইনালে, কিন্তু ভুল পরিকল্পনার খেসারত দিয়ে এবার তারা অনেক আগেই ছিটকে গেছে শিরোপার দৌড় থেকে। ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়রা টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টিকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে ওয়ানডে'র বেলায় হয়ে পড়েছিলেন উদাসীন। দেশের হয়ে দ্বি-পাক্ষিক সিরিজ বাদ দিয়ে মগ্ন ছিলেন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে। প্রকৃতির বিচারেই শেষ চারে জায়গা হয়নি ইংল্যান্ডের। ভারতের মাটিতে সবশেষ বিশ্বকাপে ফাইনালে খেলা শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক সমস্যার সঙ্গে ভুগছে পরবর্তী প্রজন্মের কুমার সাঙ্গাকারা-মাহেলা জয়াবর্ধনে-লাসিথ মালিঙ্গাদের মানের ক্রিকেটারদের খুঁজে পেতে। বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে চমক জাগিয়ে আসা নেদারল্যান্ডসের দৌড় দুটো চমক পর্যন্তই, তারা হারিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা ও বাংলাদেশকে। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডে যে অস্থিরতা, তার প্রভাব পড়েছে দলের খেলাতেও। সেরা একাদশটা বাছতে ভুল করেছে বারবার। বড় মঞ্চের ক্রিকেটার ফখর জামানকে বসিয়ে রেখে খেলানো হয়েছে প্রধান নির্বাচক ইনজামাম-উল-হকের ভাইপো ইমাম-উল-হককে। বিতর্ক ওঠায় বিশ্বকাপের মাঝপথেই পদত্যাগ করেন ইনজামাম, এরপর রহস্যময় কারণে একাদশে দেখা যায় না ইমামকেও। ১৫০ কিলোমিটার গতির বোলার হারিস রউফ বিশ্বকাপে ৫০০'র উপরে রান দিয়েছেন। বুঝতে পেরেছেন গতিই সব নয় ওয়ানডে ম্যাচের বোলিংয়ে। আফগানিস্তান টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বেশ সমীহ করার মতো দল হয়ে উঠছিল তাদের লেগস্পিনারদের কল্যাণে। কিন্তু এই বিশ্বকাপে তারা দেখিয়ে দিলো তাদের ব্যাটিংটাও সাহসী। ইব্রাহিম জাদরান, রহমানউল্লাহ গুরবাজদের ব্যাটে ভর করেই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড,পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেদারল্যান্ডসকে হারিয়েছে আফগানরা। অস্ট্রেলিয়াকেও চেপে ধরেছিল ৯১ রানে ৭ উইকেট তুলে নিয়ে, কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের অতিমানবীয় ইনিংসের কাছে হার মানতে হয় অনভিজ্ঞ আফগানদের। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটা জিততে পারলে আর শুরুতেই বাংলাদেশের কাছে হেরে না গেলে সেমিফাইনালে খেলতেই পারতো আফগানরা।

নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকা, বরাবরের সেমিফাইনালের দল। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। ব্ল্যাকক্যাপরা টানা ৪ ম্যাচ জিতে বিশ্বকাপে দারুণ শুরুর পর ভারতের কাছে হারলো, এরপর হারতেই থাকলো। টানা চার ম্যাচ হেরে তারপর শেষ গ্রুপ ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে চতুর্থ দল হিসেবে এলো সেমিফাইনালে। তারপর ভারতের কাছে হেরে বিদায়। কিছুটা দূর্ভাগাও বলা যায় তাদের। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩৮৮ রান তাড়া করে ৫ রানে হার, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৪০১ রান করেও বৃষ্টি আইনে হার তাদের পয়েন্ট টেবিলে নীচে ঠেলেদেয়। চতুর্থ স্থানটার চেয়ে উপরে শেষ করতে পারলে ভারতের সঙ্গে সেমিফাইনালে দেখা হওয়াটা এড়াতে পারতো নিউজিল্যান্ডো, তখন হয়তো টানা তৃতীয় ফাইনালের দেখা পেয়ে যেত কিউইরা।

১৯৯৯'র বার্মিংহামের স্মৃতি ফিরে এসেছিল ইডেনে। দক্ষিণ আফ্রিকা আগে ব্যাট করে অলআউট হয় ২১২ রানে, দুই যুগ আগে ডোনাল্ড আর ক্লুজনারের সেই পাগুলে দৌড়ের ম্যাচেও প্রোটিয়াদের সামনে লক্ষ্য ছিল ২১৩ রানের। এবারের সেমিফাইনালও হয়েছে টানটান উত্তেজনার, রোমাঞ্চের। লো-স্কোরিং থ্রিলারটা শেষ পর্যন্ত জিতে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়াই,কামিন্সই জয়সূচক বাউন্ডারিতে অষ্টমবারের মতো ফাইনালে পৌঁছে গেছে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নরা। আরো একবার চাপের মুখে ভেঙে পড়লো দক্ষিণ আফ্রিকা। অথচ বিশ্বকাপে খেলতে আসার আগে অস্ট্রেলিয়াকে নিজের দেশে টানা ৩ ম্যাচে হারিয়ে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জিতেছিল প্রোটিয়ারা। বিশ্বকাপে আগে ব্যাটিং করে বড় রান করাটা অভ্যাস বানিয়ে ফেলেছিল তারা, গ্রুপ-পর্বে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল ১৩৪ রানে। অথচ সেমিফাইনালে তারাই কোনরকমে দুইশ ছাড়াল আর ক্যাচও ছাড়লো। অন্যদিকে চাপের মুখে ম্যাচটা জিতে ঠিকই ফাইনালে চলে গেল অস্ট্রেলিয়া।

শুধু ভারত-অস্ট্রেলিয়ার ফাইনালই যে ২০০৩ বিশ্বকাপকে মনে করাচ্ছে তা নয়, আফ্রিকার বুকে হয়ে যাওয়া সেই বিশ্বকাপকে মনে করিয়েছে বাংলাদেশও। টেস্ট মর্যাদা প্রাপ্তির পর, সরাসরি খেলা সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ হেরেছিল সব ম্যাচে। এমনকি কেনিয়া এবং ক্যানাডার কাছেও। এবার বাংলাদেশ যদিও হেরেছে ৯ ম্যাচের ভেতর ৭টিতে, জিতেছে আফগানিস্তান আর শ্রীলঙ্কার সঙ্গে, তবে লেগে আছে নেদারল্যান্ডসের কাছে হারের কলঙ্কও। সেমিফাইনালের স্বপ্ন দেখিয়ে দেশ ছাড়া বাংলাদেশ বিশ্বকাপের আগে পরে জন্ম দিয়েছে নানান বিতর্কের। তামিম ইকবালকে দলে না রাখা, সাক্ষাৎকারে তার প্রতি সাকিব আল হাসানের প্রকাশ্য বিষোদগারসহ অনেক কিছুই অস্থিতিশীল করেছে বাংলাদেশ দলের অন্দরমহলকে। তবে নিজের সবশেষ বিশ্বকাপ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সাকিব যা করেছেন সেটা অখেলোয়াড়চিত। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজের বিপক্ষে 'টাইমড আউট'-এর আবেদন করেছিলেন সাকিব, নিয়মসিদ্ধ হওয়াতে আম্পায়ার সেটা মঞ্জুরও করেন। তবে এজন্যে সাবেক ক্রিকেটার থেকে শুরু করে অনেকেই সমালোচনা করেছেন সাকিবের।

বাংলাদেশের যে ১৫জন ক্রিকেটার বিশ্বকাপে খেলেছেন, তাদের ভেতর অভিজ্ঞরা পারেননি দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার সুফল এনে দিতে আর তরুণরা পারেননি বিশ্বমঞ্চে নিজেদের মেলে ধরতে। যেমনটা পেরেছেন নিউজিল্যান্ডের রাচিন রবীন্দ্র বা আফগানিস্তানের রহমানউল্লাহ গুরবাজ। মাহমুদউল্লাহ নিজের শেষ বিশ্বকাপে শতরান করেছেন, তবে সেটা খেলার ফলে অহেতুক বিলম্ব ঘটানো ছাড়া কোন প্রভাব রাখেনি। মুশফিকও পারেননি আস্থার প্রতিদান দিতে। আর সাকিবের বিশ্বকাপ অভিযানটা যেন তার ক্যারিয়ারেরই বনসাই।পারফরম্যান্স, বিতর্ক, চোট-সবই ছিল ৭ ম্যাচের অধ্যায়ে।

যোগ্য দুই দলই মুখোমুখি হবে রবিবারের ফাইনালে। জমজমাট এক ফাইনালেরই অপেক্ষা থাকবে ক্রিকেটপ্রেমীদের। বিশ্বকাপটা শুরুতে ম্যাড়ম্যাড়ে মনে হলেও শেষ অংকে এসে ঠিকই জমে উঠেছে। রান উৎসব, বড় রান তাড়ার খেলা থেকে লো-স্কোরিং থ্রিলার-সবই দেখা গেছে মাসদেড়েকের ক্রিকেট উৎসবে। তবে মানতে দ্বিধা নেই, একপেশে ম্যাচের সংখ্যাই বেশি। টি-টোয়েন্টির আগ্রাসনে ওয়ানডের অস্তিত্ব বিপন্ন। তবে বিশ্বকাপ জানান দিলো, ওয়ানডে এখনো কত চমৎকার এবং টক্কড়ের। অফিশিয়াল থিম সংয়ে গত মাসদুয়েক ধরে এটাই তো গেয়ে শোনাচ্ছেন প্রীতম!