আবার অশান্ত হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম
৬ জানুয়ারি ২০১৮অবরোধে তেমন কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। গেল মাসেই রাঙামাটিতে খুন হয়েছেন স্থানীয় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অরবিন্দ চাকমা। এছাড়া প্রতিদিনই রাঙামাটিতে গোলাগুলি হচ্ছে।
এতে করে পার্বত্য এলাকার মানুষের মধ্যে এক ধরনের অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। রাঙামাটিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকশ' নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে গত পহেলা জানুয়ারি সন্তু লারমার সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পার্বত্য এলাকায় নানান মেরুকরণ হচ্ছে। ফলে সেখানকার পরিস্থিতি ক্রমই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বিশেষ করে সরকার পন্থী একটি গ্রুপ তৈরি হচ্ছে৷ অন্যদিকে পার্বত্য এলাকার মানুষের পক্ষে থাকছেন কিছু মানুষ৷’’ বলছিলেন তিনি৷ ‘‘এদিকে, পার্বত্য এলাকার মানুষের পক্ষে যারা, তাদের মধ্যে আবার বিভাজন বেশি। ফলে তাদের দাবি দাওয়া পূরণ হচ্ছে না। যদিও তারা আলাদা আলাদা প্লাটফর্মে থেকেই কিন্তু কাজ করতে পারে। সে কাজটা হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া। এই চুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যেত।''
সর্বশেষ গেল বুধবার বেলা ১২টায় মিঠুন চাকমাকে খাগড়াছড়ি সদরের সুইচগেট এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয়। মিঠুন চাকমার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বাধা দেওয়ার প্রতিবাদ ও হত্যাকারীদের গ্রেফতার দাবিতে শনিবার খাগড়াছড়িতে সকাল সন্ধ্যা সড়ক অবরোধ করেছে তার সংগঠন।
অবরোধে চলাকালে খাগড়াছড়ি শহরে পুলিশের কড়া নিরাপত্তায় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা নাইটকোচগুলো প্রবেশ করলেও দূরপাল্লার কোনো যানবাহন খাগড়াছড়ি ছেড়ে যায়নি।
অবরোধ সমর্থনে জেলার বিভিন্ন স্থানে পিকেটিং করতে দেখা গেছে। দুপুরে জেলা শহরের কলেজিয়েট স্কুল এলাকায় পুলিশ ও পিকেটারদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।
এ সময় উত্তেজিত পিকেটারেরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট, পাটকেল ছুঁড়লে পুলিশের একজন কর্মকর্তা সামান্য আহত হন। পিকেটাররাও দু'একজন আহত হন।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আলী আহমেদ খান বলেন, ‘‘দু'একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া অবরোধ ছিল শান্তিপূর্ণ। মিঠুন চাকমা হত্যার ঘটনায় তার পরিবার এখনো মামলা করেনি। আজকের (শনিবার) মধ্যে তার পরিবার মামলা না করলে আমরা পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা করব। তবে হত্যাকান্ডের গোপন তদন্ত আমরা করছি। এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি।''
ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা যেটা শুনেছি, দুইটা ইউপিডিএফ ভেঙে গণতন্ত্রিক নমে নতুন একটি দল গঠন হয়েছে। এই দল ভাঙা গড়ার মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এ হত্যাকান্ড ঘটে থাকতে পারে। তবে আমরা তদন্ত শুরু করলে আসল অপরাধী যেই হোক না কেন তাকে গ্রেফতার করা হবে।''
এদিকে, মিঠুন চাকমার হত্যার জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দিকেই আঙুল তুলেছেন তার সংগঠনের নেতারা।
এর আগে গত ৫ ডিসেম্বর রাঙামাটির জুরাছড়ি যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অরবিন্দ চাকমা দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হয়। একই দিন বিলাইছড়িতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রাসেল মারমাকে নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে বেধড়ক শারীরিক নির্যাতন চালায় দুর্বৃত্তরা। এতে মারাত্মক আহত হন রাসেল মারমা। এসব ঘটনার প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য দেয়ায় রাঙামাটি শহরের ভালেদী আদম এলাকায় তার নিজ বাড়িতে ঢুকে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ঝরনা চাকমার ওপর হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা।
এসব ঘটনায় কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় রাঙামাটি জেলা ও উপজেলাগুলোতে আওয়ামী লীগ নেতাদের পদত্যাগের হিড়িক পড়ে। শুধুমাত্র জুরাছড়ি উপজেলাতে পদত্যাগ করেছেন ৩১৯ নেতাকর্মী। এই পরিস্থিতিতে জুরাছড়িতে আওয়ামী লীগের উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড শাখা এখন বিলুপ্তপ্রায়। বাঘাইছড়ি উপজেলায় দলত্যাগ করেছেন আওয়ামী লীগের চার নেতাকর্মী। এছাড়া রাঙামাটির বরকল, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বন্দুক ভাঙ্গা, রাজস্থলী, বাঘাইছড়ি ও রাঙামাটি সদর উপজেলায় ব্যাপকহারে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতাকর্মীরা পদত্যাগ করেছে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। তবে এ পর্যন্ত কতজন পদত্যাগ করেছে সে কথা বলতে নারাজ আওয়ামী লীগ নেতারা।
তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, অরবিন্দু চাকমাকে হত্যা, রাসেল মারমাকে প্রাণনাশের চেষ্টা, ঝরনা খীসাকে কুপিয়ে মারাত্মক আহত করার পরও কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় আওয়ামী লীগের বহু দ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতাকর্মী পদত্যাগ করছেন।
অবৈধ অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নেতাকর্মীদের পদত্যাগে বাধ্য করছে অস্ত্রধারী আঞ্চলিক সংগঠনগুলো। সর্বশেষ রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিশ্বদ্বয় তঞ্চাঙ্গ্যাকে (৩৫) গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেছে দুর্বৃত্তরা।
গত ২ জানুয়ারি রাতে উপজেলার দুর্গম তিন নম্বর ফারুয়া ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে।