আগে পেট, তারপর করোনা
১২ জুন ২০২০কলকাতা বিমানবন্দরে যখন দিল্লির ফ্লাইট নামলো, কাতারে কাতারে মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ থার্মাল চেক আপ হলে তবে মুক্তি৷ দীর্ঘদিনের অপেক্ষার শেষে বাড়ি ফেরার সুযোগ হয়েছে সকলের৷ দেখলেই বোঝা যায়, তাঁদের অনেকেই এই প্রথম প্লেনে চড়লেন৷ হয়তো এই শেষ!
হাজার দশেক টাকা খরচ করে বিমানের টিকিট কেটেছিলেন সহযাত্রী শ্রমিক৷ দিল্লির অদূরে একটি কারখানায় কাজ করতেন ঠিকা কর্মচারী হিসেবে৷ লকডাউনে কাজ গিয়েছে৷ বার বার ভেবেছেন হেঁটে ফিরে আসবেন৷ কিন্তু এক একটা মৃত্যু ভাবনায় বাঁধ দিয়েছে৷ একমাস কার্যত একবেলা খেয়ে সঞ্চয়ের সর্বস্ব উজাড় করে, স্ত্রীর গয়না বেচে প্লেনের টিকিট কেটেছেন ভদ্রলোক৷ কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে চুমু খেয়েছেন মাটিতে৷
সফটওয়্যার আপডেটের মতো আপডেটেড হয়েছে ভারতের লকডাউন৷ এখন চলছে লকডাউন ৫.০ এবং আনলক ১.০৷ ৩০ জুন পর্যন্ত চলবে এই প্রক্রিয়া৷ সরকার বিবৃতি প্রকাশ করে জানিয়েছে, এই সময় পর্বে কী কী খুলবে, কী ভাবে খুলবে, বন্ধই বা থাকবে কী কী৷ কিন্তু ক’জন খোঁজ রাখেন তার? ক’জনের খোঁজ রাখার পরিস্থিতি আছে?
আনলক পর্ব গোটা দেশে শুরু হয়েছে ৮ জুন৷ কলকাতায় তা শুরু করে দিয়েছে আমফান৷ লকডাউন কাজ কেড়েছিল, আমফান ঘর কেড়ে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের৷ পেটে কিল দিয়ে প্রায় দুই মাস ধরে যাঁরা করোনা ভয়ে গৃহবন্দি ছিলেন, আমফান তাঁদের আশ্রয়হীন করেছে৷ তাঁরা বুঝে গিয়েছেন, তাঁদের দেখার কেউ নেই৷ ফলে আর বাড়িতে বসে থাকা যাবে না৷ মে মাসের শেষ পর্ব থেকে জুনের শুরু, স্বচক্ষে দেখে এসেছি কাতারে কাতারে মানুষ মাঠে কাজ করতে শুরু করে দিয়েছেন৷ নৌকো, জাল নিয়ে নেমে পড়েছেন নদীতে৷
গ্রামে, সদরে, মফস্বলে, শহরতলিতে লকডাউনের হুমকিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ছোট ছোট দোকানদাররা ঝাঁপ তুলে দিয়েছেন৷ দেদার বিক্রি হচ্ছে চপ, রোল, হান্ডি বিরিয়ানি৷ লোকে কিনছেও৷ কলকাতায় প্যাডেল চালিয়ে দিয়েছেন রিক্সচালক৷ অটো চালকরা পাঁচজন সওয়ারি নিয়েই রুটের ভাড়া খাটছেন৷ বাড়ির পরিচারিকারা জোর করে কাজে ফিরতে চাইছেন৷ মধ্যবিত্ত এখনও সন্ত্রস্ত করোনা নিয়ে, তবে তাঁরাও বুঝে গিয়েছেন, এ ভাবে বাড়িতে বসে চাকরি আর বাঁচবে না৷
না, পশ্চিমবঙ্গে সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই৷ অধিকাংশের মাস্ক গলার কাছে৷ গরম আর আর্দ্রতায় মাস্ক মুখে রাখা যাচ্ছে না৷ দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় নদীবাঁধ ভেঙেছে৷ ঘরহারা হাজার হাজার মানুষ কোদাল, শাবল নিয়ে খালি গায়ে মাটি ঢালছেন বাঁধের মুখে৷ না, তাঁদেরও মাস্ক নেই৷ গায়ে দেওয়ার জামাও নেই৷ বিমানে যে শ্রমিক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তাঁর বাড়ি সুন্দরবনে৷ বলছিলেন, বাড়ি কার্যত ভেঙে পড়েছে৷ গ্রামের ভিতর জোয়ার ভাটা চলছে৷ পৌঁছেই কোদাল শাবল নিয়ে নেমে পড়বেন বাঁধ সারানোর কাজে৷ সরকারের উপর কোনো ভরসা নেই৷ জানি না হিঙ্গলগঞ্জে লঞ্চ থেকে দেখা বাঁধ সারাইয়ের কাজে তিনিও ছিলেন কি না৷
পাড়ার বাজারে দরদর করে ঘামতে ঘামতে মুরগি কাটছেন যে পরিচিত দোকানদার, তাঁর মাস্কও গলায়৷ মুখে লাগালে চশমা ঝাপসা হয়ে যায়৷ দুইবার অনুরোধ করেছিলাম, মাস্কটা মুখে লাগান৷ একরাশ ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমফানে ঘরের চাল উড়ে গিয়েছে৷ লকডাউনে সমস্ত টাকা শেষ৷ এ বার চশমা ঝাপসা হলে আঙুলটাও যাবে৷ ও সব করোনা টরোনা বড়লোকদের অসুখ৷ তাঁদের টেস্ট হয়৷ আমার হলে কেউ জানতেও পারবে না৷ না খেয়ে মরার চেয়ে করোনা তুলে নিলে তুলে নিক৷’’
অবাক লাগে শুনতে! অবাক লাগে যখন দেখি, শহরে একের পর এক সরকারি বেসরকারি অফিস খুলে যায়, কিন্তু লোকাল ট্রেন চলে না৷ রাজ্য সরকার নিয়ম করেছে বাসে ২০ জনের বেশি চড়তে পারবে না৷ কে শোনে কার কথা? বাদুড়ঝোলা ভিড় দিকে দিকে৷ লোকাল ট্রেন চলছে না বলে সমস্যায় পড়েছেন মফস্বল গ্রামের লোকেরা৷ প্রতিদিন কয়েক লাখ মানুষ লোকালে চড়ে কলকাতায় কাজ করতে আসেন, বেলাশেষে ফিরে যান৷ 'মানছি না মানবো না'র শহরে এ নিয়ে এতদিনে হরতাল হয়ে যাওয়ার কথা ছিল৷ হয়নি৷ দূর দূরান্ত থেকে সাইকেল নিয়ে কাজে চলে আসছেন সাধারণ মানুষ৷ কারও কোনও অভিযোগ নেই৷ সকলেই বুঝতে পারছেন, কাজ দরকার৷ রোজগার দরকার৷ শহরে যেনতেনপ্রকারেণ আসতে না পারলে চাকরি থাকবে না৷ সকলেই পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝে নিচ্ছেন নিজেদের মতো করে৷
করোনা লকডাউন আসলে একটা বিষয় বুঝিয়ে দিয়েছে৷ পেটের ভয়ের চেয়ে বড় আর কিছু নেই৷ সুন্দরবনে আমফান বিধ্বস্ত যে মানুষগুলি এই গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাঁধে দাঁড়িয়ে থাকছেন শুধু একটু জল পাওয়ার জন্য, করোনা এবং তা ঘিরে তৈরি হওয়া নিয়ম সত্যিই তাঁদের কাছে বিলাসিতা৷ এখনও অচিন গ্রামের যে মা প্রসব যন্ত্রণা হলে তিন ঘণ্টার রাস্তা পেরিয়ে হাসপাতাল যান, প্রসব হয়ে যায় নৌকোর ছাওয়ার তলায়, করোনার নিয়ম তাঁর কাছেও বিলাসিতা৷ সরকারি ত্রাণের টোকেন নিয়ে নদী বাঁধে দাঁড়িয়ে থাকে যে বালিকা, করোনা শুনলে তার চোখে বিস্ময় ধরা পড়ে৷ বাড়ির ইএমআই, সন্তানের টিউশন ফি, বাবা মায়ের ওষুধের খরচ গুণতে গুণতে যে মধ্যবিত্ত সপ্তাহান্তে একটু আয়েসের স্বপ্ন দেখতেন, লকডাউন তাঁর চাকরি খেয়েছে৷ হ্যাঁ, এই মুহূর্তে করোনার ভয় তাঁর কাছেও বিলাসিতা৷ হন্যে হয়ে চাকরি খোঁজার সময় বাসে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা মাথায় থাকে না৷
সরকার জানে না এরপর কী হবে৷ কেন্দ্রও নয়, রাজ্যও নয়৷ লকডাউন থাকতে থাকতেই দেশে করোনা সংক্রমণ আকাশ ছুঁয়েছে৷ তবু বাধ্য হয়ে লকডাউন শিথিল করতে হচ্ছে৷ অর্থনীতির হাল বেহাল৷ কী হবে কেউ জানে না৷
একসময় বলা হতো, বাংলা আজ যা করে, বাকি ভারত তা করে আগামীকাল৷ কলকাতা থেকে দিল্লির ফিরতি বিমানে ওঠার সময় সত্যি সত্যিই সে কথাটা মনে হলো৷ একরাশ করোনা আতঙ্ক নিয়ে কলকাতা গিয়েছিলাম৷ একরাশ ভয়াবহতার দৃশ্য নিয়ে ফিরতি প্লেনে চড়লাম৷ না, করোনা নিয়ে আর ভাবছি না৷ মানুষ একটু খেতে পাক আগে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷