1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘অর্থনৈতিক অবস্থা যত ভালো হবে অভিবাসন তত  বাড়বে’

২৩ অক্টোবর ২০২০

বাংলাদেশে চাকরিতে ঢুকতে গেলে যে ধরনের রাজনৈতিক যোগাযোগ ও লাখ লাখ টাকা ঘুস দিতে হয়, অনেকেই সেই টাকা দিয়ে চাকরিতে না ঢুকে ভাল জীবিকার আশায় অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন৷

https://p.dw.com/p/3kK2B
ছবি: Private

ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী৷

তার মতে, বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে তারা যে দেশে যাচ্ছেন, তাদের ধারণা সেখানে থাকতে পারলে কয়েক মাসের মধ্যে এই টাকা উঠে যায়৷ সঙ্গে একটা বেটার লাইফও মেলে৷ 

ডয়চে ভেলে : বসনিয়ার জঙ্গলে কয়েকশ' বাংলাদেশি মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন৷ ডয়চে ভেলের দুইজন সাংবাদিক সরেজমিনে সেখানে গিয়ে তাদের করুণ অবস্থার চিত্র দেখেছেন৷ সাগর পথেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে যাওয়ার কথা আমরা জানি৷ এই প্রবণতা কেন?

অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী : একটা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশিরা বিভিন্ন দেশে অভিবাসন করে আসছে৷ যারা মধ্যপ্রাচ্যে গেছেন তাদের অনেকেই কাজ শেষ করে দেশে ফেরার সময়ে চেষ্টা করেন ইউরোপে ঢুকে যেতে৷ আবার আমাদের মফস্বল শহরগুলোর অনেক স্নাতক অভিবাসন করতে চান৷ কারণ তারা ‘ছোট’ চাকরি করতে চান না৷ এদের অনেকেরই ইউরোপে কানেকশন আছে৷ সেখানে থাকা আত্মীয়রা বলেন, কোনভাবে এখানে এসে পড়তে পারলে পরবর্তী কাজের সুযোগগুলো তারা করে দেবেন৷ এই পরিস্থিতিতে তারা খানিকটা জেনে, খানিকটা না জেনে এই পথে পা বাড়ান৷ আর এই সুযোগটা নেয় দালাল বা সাব এজেন্টরা৷ আগে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ থেকে সরাসরি প্লেনে সিরিয়া নেমে সেখান থেকে ইউরোপ যেতেন৷ পরে দেখেছি, ভারত হয়ে তারা যাচ্ছেন৷ সম্প্রতি আমরা দেখছি, তারা বসনিয়ার পথ ধরে যাচ্ছেন এবং সেখানে গিয়ে আটকে আছেন৷ এই মানুষগুলো অভিবাসনের ফলাফল জানেন৷ যদি তারা একবার পৌঁছে যেতে পারেন তাহলে লুকিয়ে থেকে কাজ করার সুযোগ পান বা অনেক সময় ক্ষমাও প্রদর্শন করা হয়৷ এইসব চিন্তা থেকেই তারা এই পথে যাচ্ছেন৷

মফস্বলের অনেক স্নাতক ‘ছোট’ চাকরি করতে চান না: ড. তাসনিম সিদ্দিকী

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর কি পরিমাণ মানুষ অবৈধভাবে বিদেশে যান?

তেমন হিসেব নেই৷ তবে আইওএমের কতগুলো হিসাব আছে৷ গত বছর তারা ৭০০ এর মতো কেস পেয়েছেন যারা অবৈধ অভিবাসনের জন্য লিবিয়া গেছেন৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আইওএমের কাছ থেকে এমন কিছু পরিসংখ্যান মাঝে মধ্যে পাওয়া যায়৷ এমন কথাও বলা হচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় অবৈধ অভিবাসনের জন্য যারা আটকে আছেন তাদের একটা অংশ বাংলাদেশি৷

এই অবৈধ মানুষগুলো যে টাকা পাঠান সেটা কি রেমিটেন্স হিসেবে আসে? না অবৈধভাবে আসে?

দু'টোই৷ রেমিটেন্স হিসেবেও আসে৷ অবৈধ পথেও আসে৷ কারণ তারা যখন টাকাটা পাঠাচ্ছেন তখন বৈধ কাগজপত্র থাকলেই যে শুধু রেমিটেন্স পাঠাতে পারবে বিষয়টা কিন্তু তেমন না৷ অন্যদিকে ভাই বোন বা যে আত্মীয় সেখানে আছেন, তারা যদি বৈধ হন তাদের মাধ্যমেও কিন্তু বৈধভাবে তারা টাকা পাঠাচ্ছেন৷ ফলে যারা বৈধভাবে যাননি তাদের অনেকের টাকাও বৈধপথে আসে৷

বসনিয়ার জঙ্গলে যারা আটকে আছেন তাদের অনেকের সঙ্গেই কথা বলেছেন ডয়চে ভেলের সাংবাদিকেরা৷তারা বলেছেন, কারো কারো ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকাও খরচ করতে হয়েছে বসনিয়া পর্যন্ত পৌঁছতে৷ এই বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে এই অনিশ্চয়তা বেছে নেওয়া কেন?

বিদেশে যাওয়ার পর ওখানে যে বেতনটা পাওয়া যাবে সেটার কারণে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা ব্যয় করা যায় বলেই তারা মনে করেন৷ আমি দেখেছি, জাস্ট সেলার থেকে মদের বোতল উপরে তুলে এই অবৈধ অভিবাসীরা যে টাকা আয় করেন তাতে কয়েক মাসের মধ্যে ১৫ লাখ টাকা তারা তুলে ফেলতে পারেন৷ সেক্ষেত্রে এই রিস্ক তো তারা নেবেনই৷তাছাড়া সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করা হলে তো তারা দীর্ঘ সময় সেখানে থেকে যেতে পারবেন৷ এই কারণে তারা জীবন বাজি রেখে সেখানে যান৷

বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বেশ ভালো৷ তাহলে এভাবে কেন ঝুঁকি নিয়ে মানুষ বিদেশে যাচ্ছেন?

অভিবাসনের তত্ত্ব বলে অর্থনৈতিক অবস্থা যত ভালো হবে অভিবাসন তত বেশি বাড়বে৷ মানুষের বড় হবার উচ্চাকাঙ্খা বাড়বে৷ অভিবাসনের থিওরি বলে অর্থনীতি ভালো হলে অভিবাসন বাড়বে৷ উল্টোদিক থেকে আমরা যদি দেখি,বিশ্বায়নের ভেতরে আমরা ঢুকে গেছি৷ আমাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থায় যে কোন কর্মক্ষেত্রে ঢুকতে গেলে যে ধরনের রাজনৈতিক যোগাযোগের প্রয়োজন পড়ে, দলীয়করণের শিকার হতে হয় সেই সব জায়গায় এই দেশে অনেকে কোন ভবিষ্যত দেখেন না৷ সুতরাং তারা এমন একটা জায়গায় যেতে চান যেখানে আইনের শাসন আছে এবং যে কাজটা করবেন তার নায্য পারিশ্রমিক পাবেন৷ এখানে আমাকে একটা সরকারি চাকরি পেতে গেলে লাখ লাখ টাকা ঘুস দিতে হয়, সেই ঘুসটা না দিয়ে তারা একটা বেটার সিস্টেমের দিকে যেতে চান৷ 

এভাবে লোক পাঠিয়ে আরও রেমিট্যান্স আনার প্রয়োজন আছে কিনা?

একেবারেই না৷ সরকারকে আমরা দায়বদ্ধ করতে চায় যে, বৈধ পথে অভিবাসনের সুযোগ সৃষ্টি করলে অবৈধ পথে অভিবাসনের চেষ্টা কমে যাবে৷ বৈধ পথে যাওয়ার প্রক্রিয়াটা শুরু করতে গেলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়ে স্কুল থেকে অভিবাসনবান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে৷ ভকেশনাল ট্রেনিংকে গুরুত্ব দিতে হবে৷ মানুষ যখন তার স্কিল দিয়েই বিদেশে যেতে পারবেন তখন তাকে এই অবৈধ পথ বেছে নিতে হবে না৷ এই ট্রেনিং এর দিকে দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে না৷

অবৈধভাবে যারা যাচ্ছেন, তারা থিতু হওয়ার পর একইভাবে অন্যদের যেতে উৎসাহিত করেন কি-না?

অবশ্যই৷ অবশ্যই৷ একজন যখন যান তখন তিনি আত্মীয় স্বজনকে নেন৷ এভাবে বিষয়টি ছড়িয়ে পাড়ে৷ দীর্ঘদিন সেখানে থাকার পর নানা প্রক্রিয়ায় তারা সেখানে বৈধ হয়ে যান৷ তা না হলেও কাজের একটা সুযোগ পান৷ এভাবে যারা যাচ্ছেন তারাই আবার অন্যদের যেতে উৎসাহিত করছেন৷ আবার দালাল যে চক্র তারাও কিন্তু উৎসাহিত করেন৷বাইরের র‌্যাকেটগুলো আমরা ধরতে না পারলেও দেশীয় র‌্যাকেট তো সরকার চাইলে ধরতে পারে৷ মাঝে মধ্যে দালালদের ধরা হয়৷ কিন্তু যাদের মাধ্যমে দালালরা এটা করছে তাদের কিন্তু ধরা হচ্ছে না৷ তাদের ধরলে এই প্রক্রিয়াটা কমে আসত৷ 

যেসব দালাল এভাবে মানুষকে বিদেশে পাঠাচ্ছে তাদের গ্রেফতারে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কতটা আন্তরিক?

আপনারা তো দেখেছেন লিবিয়ায় ২৬ জনকে যে হত্যা করা হল, এরপর অন্তত সাত দিন আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা ব্যাপক অভিযান চালিয়ে দালালদের ধরে ফেলল৷ সব দালালই কিন্তু দু'টি রিক্রুটিং এজেন্সির নাম বারবার বলছে৷ কিন্তু তারপর কি আর আমরা জানতে পেয়েছি কিছু৷ ২০১৪-২০১৫ সালে আমরা দেখেছি, রোহিঙ্গাদের অবৈধপথে পাঠানোর জন্য আমরা কাদের নাম দেখলাম৷ সংসদ সদস্যদের নাম আমরা দেখতে পেলাম৷ তাদের কি আমরা কোনভাবে আইনের আওতায় আনতে পেরেছি৷ আজকে কাতার-কুয়েতে মানব পাচারের দায়ে আমাদের সংসদ সদস্য গ্রেফতার হয়েছেন৷ আমরা কি পদক্ষেপ নিয়েছি যে, আর কোন সংসদ সদস্য বা কোন ব্যক্তি এই ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হবেন না?  

অবৈধভাবে প্রাণ হাতে নিয়ে বিদেশ যাওয়া নিরুৎসাহিত করতে সরকারি কোন উদ্যোগ কি আপনার নজরে এসেছে?

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন গ্রুপ আছে, এছাড়া বিভিন্ন এনজিও তো অবৈধভাবে বিদেশে যেতে বারণ করছেন৷নিয়মিত কথা বলছেন৷ আইওএমের প্রোজেক্ট আছে৷ এমনকি যারা অবৈধভাবে গেছেন তাদের ফেরত এনে পূর্নবাসনের চেষ্টাও তো আছে৷ এসব কিন্তু কোন ফল দিতে পারছে না৷ যারা এগুলো প্রোসেস করছে তাদের যদি শাস্তি দেওয়া যেত তাহলে এটা কমে যেত৷ 

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কি?

উত্তরণের দু'টো পথ৷ একটা দীর্ঘমেয়াদি, একটা স্বল্পমেয়াদি৷ দীর্ঘমেয়াদি হল আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে৷ স্কিল মাইগ্রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে৷ দ্বিতীয়ত হল এই দালালদের ধরতে হবে৷ পাশাপাশি যেসব রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে এরা যাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ আপনারা ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন তাদেরকে কারা পাঠিয়েছেন তাদের খুঁজে বের করে ধরতে হবে৷ এখনই কিন্তু সেই সময়টা৷ এটা করলেই একটা ভালো ফল মিলবে বলে আমি বিশ্বাস করি৷

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য