অবশেষে নিষিদ্ধ হলো জামায়াত
১ আগস্ট ২০২৪স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রজ্ঞাপনে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মঙ্গলবারই বলেছিলেন, বুধবার জামায়াত নিষিদ্ধ হবে। বুধবার বিকেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও বলেছিলেন, যে কোনো সময় প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। অবশেষে সেই প্রজ্ঞাপনটি জারি হলো।
এবারের নিষিদ্ধ ঘোষণার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো দলটি নিষিদ্ধ হলো। ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত হবার পর পাকিস্তানভিত্তিক এই রাজনৈতিক দলটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় গণহত্যায় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতার জন্য ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৭৫ সালে প্রথম রাষ্ট্রপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর এবং কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থানের পালাবদলে ১৯৭৭ সালে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে দলটির নেতা-কর্মীরা দেশে ফিরে আসার অনুমতি পান এবং ১৯৭৯ সালের মে মাসে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা আব্বাস আলী খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেয়া হয়। মূলত জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর একটি শাখা।
উচ্চ আদালতের রায়ে ২০১৩ সালে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। জামায়াতের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল। তবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের পক্ষের আপিল খারিজ করে দেয়। দলটির নিবন্ধন বাতিলের ফলে বাংলাদেশে প্রতীক নিয়ে এককভাবে (দলীয়ভাবে) নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা হারায়। মানবতাবিরোধী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল থেকেও এক আদেশে এই দলটিকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করে নিষিদ্ধ করার আদেশ দিলেও সরকার দীর্ঘদিন এই রায় বাস্তবায়ন করেনি। অবশেষে নির্বাহী আদেশে সরকার এটি করলো।
অধ্যাপক মুনতাসির মামুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "দেরিতে হলেও সরকার যে এই কাজটি করেছে সেটিকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে গত ২০ বছরে তারা যে আর্থিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে, সেটাকে সরকার কিভাবে মোকাবেলা করবে, সেটাই দেখার বিষয়। আমাদের সমস্যা হয়েছে, যারাই সরকারে যায়, তারা সবাইকে প্রজা মনে করে। আমার বন্ধুরাও, যারা সরকারের দায়িত্বশীল পদে গেছেন, তারাও আমাকে মনে করেন কিছুই বুঝি না। ফলে যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন সবাইকে আস্থা নিয়ে সামনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।”
গত ১৯ জুলাই রাতে শেখ হাসিনার সঙ্গে ১৪ দলের বৈঠকের পর জামায়াতে ইসলামী ও তার সকল অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ১৪ দলীয় জোটের চেয়ারপারসন, সেখানে শরিক দলগুলোর বক্তব্য, তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ, দলটির অতীত ও বর্তমান কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন সময় দেওয়া আদালতের রায় ইত্যাদি বিবেচনায় জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধে ১৪ দল সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আগে নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশে ইসলামি শরিয়াহ আইন বাস্তবায়ন এই দলের উদ্দেশ্য। দলটি ইকামতে দ্বীন (ধর্ম প্রতিষ্ঠা) নামক মতাদর্শকে মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে এবং একে ‘রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের মাধ্যমে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা' অর্থে দলীয় ও রাজনৈতিকভাবে ব্যাখ্যা করে থাকে। এটি পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর একটি শাখা এবং তা মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড-এর আদর্শ ধারণ করে।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও চলচ্চিত্র পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ডয়চে ভেলেকে বলেন, "জামায়াত নিষিদ্ধের কাজটাকে আমি স্বাগত জানালেও একটা ভয় থেকেই যাচ্ছে। সরকার এখন কিভাবে তাদের সামলাবে, সেটা দেখার বিষয়। কারণ, জামায়াত এখন আর্থিকভাবে অনেক শক্তিশালী এবং শিক্ষা ক্ষেত্রেও তারা অনেক এগিয়ে গেছে। ফলে একটা সংশয় থেকেই যাচ্ছে। তারপরও সবাই মিলেই তাদের মোকাবেলা করতে হবে।”
২০০১ সালে নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে বিএনপির সাথে মিলিত হয়ে আরো অন্য দুটি দলসহ চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোট জয়লাভ করলে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারে জামায়াতের তৎকালীন আমীর ও সেক্রেটারি জেনারেল মন্ত্রী নিযুক্ত হন। মূলত তখনই তাদের শক্তি ও আর্থিক সামর্থ্য কয়েকগুণ বেড়ে যায় বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। যদিও নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীও ছিল। তবে তাদের কোনো জোট ছিল না।
২০১০ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে গণহত্যায় অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে। ২০১২ সালের মধ্যে দুজন বিএনপি নেতা ও জামায়াতের সাবেক ও বর্তমান সদস্যসহ বেশ কিছু নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৩ সালের জুলাই পর্যন্ত জামায়াতের সাবেক সদস্যসহ অনেকের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা ও একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছর কারাদণ্ড প্রদাণ করা হয়।
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার ফলে বিএনপির লাভ হয়েছে বলে মনে করেন বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "এই দলটাকে নিষিদ্ধ করার দরকার ছিল অনেক আগেই। এবার তারা যে তাণ্ডব চালিয়েছে, সে কারণে হয়ত সরকার এখন মনে করছে, এটা করা প্রয়োজন। যা-ই হোক, কাজটি ভালো হয়েছে। এতে বিএনপিরই লাভ হলো। এরা এতদিন নিজেদের স্বার্থে বিএনপিকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে। এখন বিএনপি এই বোঝা থেকে মুক্ত হতে পারবে বলেই আমি মনে করি।”
এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘‘যে কোনো সময় (নিষিদ্ধের) ঘোষণা হবে। জামায়াত আগেই নিষিদ্ধ ছিল। জিয়াউর রহমান এসে তাদের আবার রাজনীতির অধিকারটা দিয়েছে। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলো এবং এ দেশের সুশীল সমাজ উভয়ই জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার জন্য অবিরাম বলে আসছিল। এটা জনগণের একটি দাবি ছিল। ১৪ দলের মিটিংয়ে প্রধানমন্ত্রী অনেকের মতামত নিয়েছেন। সবাই প্রধানমন্ত্রীকে জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরকে নিষিদ্ধ করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকেও দু-একটি মামলায় সিদ্ধান্তের মধ্যে লিখে দিয়েছে- এ দলটিকে জঙ্গি দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা উচিত। সবকিছু মিলিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে- এ দলকে নিষিদ্ধ করার জন্য।’’ সেই প্রক্রিয়াটি চলছে, যে কোনো সময় প্রক্রিয়াটি শেষ হলেই ঘোষণা হবে বলে জানিয়েছিলেন আসাদুজ্জামান খান।
তবে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, "ইস্যু পরিবর্তনের অপকৌশল এটি। আমরা বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমাদের এটা ঘোষিত কর্মসূচি, আমাদের আদর্শ হচ্ছে, বহুদলীয় গণতন্ত্র। পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বাম রাজনীতি যারা করতেন, মির্জা গোলাম হাফিজ থেকে শুরু করে হাজী মোহাম্মদ দানেশ থেকে শুরু করে তারা সবাই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা। প্রায় দুই বছর সেখানে থেকে ফিরে আসেন। এ ধরনের ঘটনা (সিদ্ধান্ত) যারা স্বৈরাচারী, যারা আপনার ডিক্টেটর, যাদের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না, তারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত বহু নিয়েছে এবং এগুলো তাদের নিতে হয় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে।”
লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্ণেল (অব.) অলি আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এই সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি। এটা সংবিধানবিরোধী। আমি দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি করেছিলাম। কিন্তু এখন বলছি, সরকার সঠিক কাজ করেনি। এই দলটিতে এখন আর কোনো যুদ্ধপরাধী নেই। বরং যুদ্ধপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না এমন অনেক নেতাকেও আওয়ামী লীগ ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছে। সরকার যখন শত শত ছাত্রকে হত্যা করে বেকায়দায় পড়েছে, তখনই জামায়াত নিষিদ্ধের নাটক করে বাঁচার চেষ্টা করছে। শুধু ব্রিজ করে মানুষের মন জেতা যায় না। আমি সরকারের এই ধরনের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।”