অপ্রচলিত বাজারে পোশাক রপ্তানি বাড়লেও প্রবৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কা
১৩ মে ২০২৩চলতি অর্থবছরের শেষে রপ্তানিকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নেয়া হলেও, তা অর্জন এখনও বহুদূর। ক্রয় আদেশ কমে যাওয়ায় এ বছর ৩০০টির মতো কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বেকার হয়েছেন ৩০ হাজারের মতো শ্রমিক। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, ছোট ছোট কারখানাগুলোর টিকে থাকাটাই কঠিন।
তৈরি পোশাক শিল্প ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর সিনিয়র সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইউরোপ, অ্যামেরিকা বা ব্রিটেনে আমাদের অর্ডার যখন কমছে, তখন আমরা নতুন বাজারের চিন্তা করি। সেই চিন্তা থেকেই আমরা জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো খুঁজে বের করেছি। সেখানে আমাদের রপ্তানি বেশ ভালো।’’
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলেও জানিয়েছেন এই ব্যবসায়ী৷ তিনি বলেন, ‘‘সেখানেও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। বায়াররা নতুন করে কোন অর্ডার দিচ্ছেন না। এ কারণে কিন্তু এখানে অনেক ছোট ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তারপরও ২০২৩ সালের শেষে আমরা রপ্তানি ১০০ বিলিয়নে নিয়ে যাওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছিলাম সে পথেই হাঁটছি। তবে শেষ পর্যন্ত পারব কিনা সেটা তো জানি না। তবে আমাদের চেষ্টা আছে।”
বিজিএমইএ জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম ১০ মাসে অর্থাৎ এপ্রিল পর্যন্ত অপ্রচলিত বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। এসব বাজারে প্রায় ৩০ দশমিক ৮০ শতাংশ রপ্তানি বেড়ে ৭ বিলিয়ন ইউএস ডলারে পৌঁছেছে। অপ্রচলিত বাজারগুলোর মধ্যে আছে, জাপান, অষ্ট্রেলিয়া, ভারত এবং দক্ষিণ কোরিয়া।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, এই সময়ে জাপানের প্রধান বাজারগুলোতে বাংলাদেশের পোশাক পণ্যের রপ্তানি ছিল এক দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার বাজারে ৯৬১ দশমিক ৩০ মিলিয়ন, ভারতীয় বাজারে ৮৮৯ দশমিক শূন্য ৬ মিলিয়ন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার বাজারে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৭৭ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ইউএস ডলার।
মোট রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ বেড়েছে। এ সময়ে বাংলাদেশ থেকে মোট পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩৮ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ইউএস ডলারের। এর মধ্যে ইউরোপের বাজারে গেছে ১৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারের, যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের, ক্যানাডায় রপ্তানি হয়েছে এক দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক। আর এই সময়ে অপ্রচলিত বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৭ বিলিয়ন ইউএস ডলারের।
পশমি সোয়েটার্স লিমিটেডের মালিক মো. মশিউল আযম সজল ডয়চে ভেলেকে বলেন, “যুদ্ধের কারণে ইউরোপের বাজারে আমাদের রপ্তানি অনেক কমে গেছে। তারা আসলে পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। বিভিন্ন ধরনের খরচ বাড়ায় আমাদের যেটা করতে হচ্ছে, আগে আমরা দুই তিন সুটকেস ভরে স্যাম্পল নিয়ে তাদের কাছে হাজির হতাম। এখন যেটা হয়েছে ভিডিও কলে আমরা তাদের স্যাম্পল দেখাচ্ছি।
‘‘আরেকটা জিনিস আমরা দেখছি, ইউরোপের বাজারে স্বল্প মূল্যের কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে। তারা এখন আর বেশি দাম দিয়ে কাপড় কিনছে না। এখন আসলে অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি বাড়িয়ে আমরা টিকে থাকার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি ম্যানমেড ফাইবারের ওপর আমরা অনেক বেশি মনোযোগ দিচ্ছি। এর জন্য আমরা সরকারের কাছ থেকে একটা সহযোগিতা চেয়েছি। সেটা পাওয়া গেলে হয়ত আমরা টিকে যেতে পারব।”
বিজিএমইএ কর্মকর্তা বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান বাজারগুলোর মধ্যে জার্মানিতে রপ্তানি কমেছে। বর্তমান রপ্তানির পরিমাণ ৫ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় জার্মানিতে ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ রপ্তানি কমেছে। ফ্রান্স এবং স্পেনে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ইউএস ডলার ও ২ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার। দেশ দুইটিতে পোশাক রপ্তানিতে কিছুটা প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “অর্ডার কমে যাওয়ার কারণ তো আমরা অনুধাবন করতে পারছি। ইউরোপেও চাকরির বাজার সংকুচিত হচ্ছে। সেখানে জব কাট হচ্ছে। একই সঙ্গে ডলারের বিপরীতে অন্য কারেন্সির যে মূল্যমান সেটাও কমেছে। এতে তাদের আমদানি খরচ বাড়ছে।’’
অপ্রচলিত বাজার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘অপ্রচলিত বাজারের ক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে, করোনা এবং পরবর্তী সময়ে অনেক দেশেই প্রভাবটা পড়েনি। বরং তাদের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। এর মধ্যে চীন, ভারত, জাপান আছে। সেখানে আমাদের রপ্তানি বাড়ছে। আবার চীনের সঙ্গে অনেকেরই বাণিজ্যে টানাপড়েন রয়েছে। এটা যে শুধু ইউরোপ বা অ্যামেরিকার দেশগুলো তা নয়। অস্ট্রেলিয়া, জাপান তাদের অর্ডার কিন্তু চীন থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। সেই সুবিধাটা কিন্তু আমরা পাচ্ছি, আরও পাব। ফলে আমাদের রপ্তানির গ্রোথটা ইউরোপে একটু নেগেটিভ হলেও সার্বিকভাবে ঠিক থাকবে বলে আমার ধারণা।”
বাংলাদেশ শিল্প পুলিশের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ অর্থাৎ প্রথম তিন মাসে দেশে মোট ৯৭টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এগুলো বন্ধ হওয়ার কারণে ২০ হাজার ২৭৬ শ্রমিক চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। কারখানাগুলোর মধ্যে বিজিএমইএ-এর সদস্যভুক্ত ১৭টি কারখানায় ছয় হাজার ৬৪৭ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন।
বিকেএমইএ-এর সাতটি কারখানায় এক হাজার ৪৮৬ জন, বিটিএমইএ-এর তিন কারখানায় দুই হাজার ৮৭ জন, বেপজার দুইটি কারখানায় দুই হাজার ৪৫ জন এবং অন্যান্য ৬৮টি কারখানায় আরও আট হাজার ৩২ শ্রমিক বেকার হয়েছেন।
এপ্রিলে খুলনা ও সিলেট এলাকার আরও ১৮৯টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। বেকার হয়েছেন অন্তত ১০ হাজার শ্রমিক। সবমিলিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৩০০ কারখানা বন্ধ হয়েছে। এসব কারখানায় কর্মরত প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছেন।
কারখানা বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়েছে। আরও হবে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত কার্যাদেশ নেই। এটাই মূল কারণ। আবার কিছু কারখানায় এমনিতে কাজ নেই, তারওপর আবার শ্রমিক অসন্তোষ। কথায় কথায় কাজ বন্ধ করে দেয় শ্রমিকরা। এসব কারণেও অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”