৫০ বছরের মধ্যে বিলুপ্ত হবে বাঘ?
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯তবে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে পিএইচডি করেছেন এমন দু'জন গবেষক ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, শুধু বৈশ্বিক জলাবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে এমন ধারণাকে পূর্ণ গবেষণা বলা যাবে না৷ এখানে বাঘ বিলুপ্তির সঙ্গে আরো অনেক কিছুই জড়িত৷ সেগুলো যদি মোকাবেলা করা যায়, তাহলে বিলুপ্ত না-ও হতে পারে৷ তাঁরা মনে করেন, ৫০ বছর পর কী ঘটবে এখনই সেটা ধারণা করা ঠিক হবে না৷
অষ্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের করা গবেষণাটি প্রকাশ করেছে সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট৷ সেখান থেকে বিশ্বের বহু গণমাধ্যম গবেষণাটি প্রচার করেছে৷ ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের বিপন্ন বাঘ' শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, ক্রমাগত সাগরের পানি বাড়ার কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত সুন্দরবনের বাসিন্দা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে৷ গবেষণার পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে, আগামী ৫০ বছরে, অর্থাৎ ২০৭০ সালের মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল সুন্দরবন বিলুপ্ত হয়ে যাবে৷
জাহাঙ্গীরানগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি বলবো, এক অর্থে এই গবেষণা ঠিক আছে৷ কিন্তু এটাকে পূর্ণ গবেষণা বলা যাবে না৷ যে প্রেডিকশন অনুযায়ী বলা হচ্ছে, সেখানে হয়ত সুন্দরবন এখানে থাকবে না, অন্য কোথাও থাকবে৷ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট কিন্তু সি লেভেল অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নেয়৷ সি লেভেল বাড়লে সুন্দরবন হয়ত ল্যান্ডের দিকে সরে যেতে পারে৷ বা উত্তর দিকেও সরে যেতে পারে৷ কিন্তু সুন্দরবন থাকবে না, এটা বলা যাবে না৷ আসলে আমরা কিভাবে এটাকে ম্যানেজ করব, সেটার উপর নির্ভর করবে৷ আজকে সুন্দরবন যেখানে আছে, ৫০০ বছর আগে তো এখানে ছিল না৷ যদি সুন্দরবন থাকে, তাহলে কিন্তু বাঘ থাকবে৷’’ বর্তমানে যে ক'টি বাঘ আছে, তারা কি সুন্দরবন থেকে পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে? অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান বলেন, ‘‘পর্যাপ্ত পাচ্ছে সেটা কিন্তু বলা যাবে না৷ কিন্তু আমাদের যে ল্যান্ড আছে, সেটা কিন্তু পর্যাপ্ত৷ এখানে আরো প্রাণী থাকার সুযোগ আছে৷ তবে সবকিছুই নির্ভর করছে আমাদের ম্যানেজমেন্টের উপর৷’’ বর্তমানে বাঘের সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সর্বশেষ গবেষণায় দেখা গেছে, একশ'র মতো বাঘ আছে৷ আমরা ভালোভাবে ম্যানেজ করতে পারলে এটা বাড়তেও পারে৷ আর ম্যানেজ না করতে পারলে বাঘ হারিয়ে যাবে৷’’
সর্বশেষ গবেষণাপত্রটির অন্যতম লেখক এবং জেমস কুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিল লরেন্স৷ আর গবেষণাপত্রের মূল লেখক এবং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি)-র সহকারী অধ্যাপক, বর্তমানে অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী ড. শরিফ মুকুল বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশ এবং ভারত মিলিয়ে সুন্দরবনের ১০ হাজার কিলোমিটারের বেশি এলাকা নিয়ে গঠিত প্যারাবনটি সারাবিশ্বে সুন্দরবন হিসেবে পরিচিত৷ এটিই পৃথিবীর একক বৃহত্তম প্যারাবন৷ তবে এখানে বাঘদের টিকে থাকার জন্যে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে৷’’
অধ্যাপক বিল লরেন্সের মতে, বন ধ্বংসের পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের বাইরে অন্যান্য কারণ হলো, বনাঞ্চলের পাশে কলকারখানা স্থাপন, নতুন রাস্তা তৈরি এবং নির্বিচার শিকার৷ তিনি বলেন, ‘‘একদিকে মানুষের আগ্রাসন এবং অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন বাঘের আবাসস্থলকে সঙ্কটাপন্ন করে ফেলেছে৷’’ তবে বন ও বাঘ বাড়ানোর ব্যাপারে এখনো আশা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণাটিতে৷ অধ্যাপক লরেন্স বলেন, শিকার বন্ধ করার পাশাপাশি সুন্দরবনকে সংরক্ষণ করলে সেখানকার প্রাণিগুলো পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারবে৷ আর এসবের মাধ্যমেই বাঘসহ বনের অন্যান্য প্রাণিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব৷
বাঘ নিয়ে পিএইচডি করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের আরেকজন অধ্যাপক ড. আব্দুল আজিজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘৫০ বছর পর কী হবে সেটা এখনই বলা মুশকিল৷ এর সঙ্গে যে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনই জড়িত, তা নয়৷ আরো অনেক কিছুই জড়িত৷ জলবায়ু পরিবর্তন একটা বিষয়৷ নতুন যে মডেলিংটা সামনে এসেছে, সেখানে বলা হচ্ছে, সুন্দরবন এলাকাতে ল্যান্ড ফর্মেশন হচ্ছে প্রচুর৷ উপর থেকে প্রচুর পলি নামছে৷ এর ফলে নতুন নতুন চর জাগছে৷ এমন একটি চর বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড৷ কিছুদিন আগে আমরা সেখানে বাঘ দেখেছি৷ এগুলোও যদি গবেষণায় আসতো, তাহলে কিন্তু পরিপূর্ণ হতো৷ আমার কাছে মনে হচ্ছে, একমুখী একটা গবেষণা হয়েছে৷ আমি সুন্দরবন নিয়ে বহুদিন ধরে কাজ করছি৷ আমরাও কিছু মডেলিং করেছি৷ আসলে বাঘ বেঁচে থাকার জন্য জরুরি বিষয় হল তার খাবার এবং আবাসস্থল৷ খাবারের ৮০ ভাগই আসে চিত্রা হরিণ থেকে৷ আর ১৫ ভাগ আসে ওয়ার্ল্ড বিট থেকে৷ এই চিত্রা হরিণ-শিকারীদের প্রধান টার্গেট৷ এটাকে যদি বাঁচিয়ে না রাখা যায়, তাহলে বাঘও বাঁচানো যাবে না৷’’