২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও বিরোধী দমনের রাজনীতি
২০ আগস্ট ২০২৩নিজেদের শাসনামলে ঘটে যাওয়া ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকে ‘জঘন্য ও নিন্দনীয়’ বলে মনে করে বিএনপি৷ তবে এর তদন্ত ও বিচার নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার রাজনীতি করছে বলে দাবি তাদের৷ অন্যদিকে পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও বিরোধীদলের উপর দমন-পীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে৷ যদিও তা ‘বিএনপির সময়ের তুলনায় কিছু নয়’ বলে মনে করে ক্ষমতাসীন দলটি৷
আওয়ামী লীগের চোখে গণতন্ত্রকে হত্যার চেষ্টা
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন এই হামলা ও তার পরে বিএনপির আচরণ নিয়ে সমালোচনা করেন৷ তার মতে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়ই তখন শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য হামলা করা হয়েছিলো৷ হামলার পর আওয়ামী লীগকে মামলাও করতে দেয়া হয়নি৷ উল্টো আওয়ামী লীগের ঘাড়েই দায় চাপানোর চেষ্টা করে বিএনপি-জামায়াত সরকার৷ তিনি বলেন, ‘‘১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা আর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা একই সুতোয় গাঁথা৷ একাত্তরের পরাজিত স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ও জঙ্গিরা তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবরের পরিকল্পনায় ওই হামলা চালায়৷ এটা করা হয় রাষ্ট্রীয় মদদে৷ মুফতি হান্নান তার জবানবন্দিতে বিস্তারিত বলেছে৷’’
তার বলেন, ‘‘ওই হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে৷ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যার রাজনীতি শুরু করেছে তারা৷’’
গুম, খুনসহ প্রতিপক্ষকে দমন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে শাসক দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও৷ এমন বিষয়ে তিনি দাবি করেন, ‘‘বিএনপির আমলে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে তার কিছুই হচ্ছে না এখন৷ জঙ্গিদের দমন করতে গিয়ে কিছু ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়৷ তবে বিএনপির সময়ের তুলনায় তা কিছুই না৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই একজন ভিকটিম৷ তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে৷ তাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে৷’’
‘নিন্দনীয়’ মনে করে বিএনপি
এই হামলা ও হামলার পর অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা, জজ মিয়া নাটকের ঘটনা বিএনপি ক্ষমতায় থাকা কালেই উন্মোচিত হয়৷ পরবর্তীতে আদালতের রায়ে দলটির নেতাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসে৷ এর দায়ভার নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান বলেন, ‘‘২১ আগস্টের গেনেড হামলা অবশ্যই জঘন্য ও নিন্দনীয় ঘটনা৷ আমরাও এর বিচার চাই৷ আমরা বিচার করার চেষ্টা করেছি৷ তবে এই সরকার ক্ষমতায় এসে এটাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে৷ সম্পূরক চার্জশিট দিয়ে তারেক রহমানকে আসামি করেছে৷ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আসামি করেছে৷ ফলে সত্যিকারের ঘটনা জাতি আজও জানতে পারেনি৷’’
আওয়ামী লীগকে মামলা করতে না দেয়া, আলামত নষ্ট করে ফেলা, জজ মিয়া নাটক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘মুফতি হান্নানকে চারশ’ বারের বেশি আদালতে এনে তার জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। জজ মিয়া তার জবাবন্দি এখনো প্রত্যাহার করেননি৷ কেউ তারেক রহমানের নাম বলেননি৷’’
রাজনীতিতে বড় ধরনের বিভাজন
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন ও হত্যার রাজনীতি বাংলাদেশে নতুন নয়৷ তবে ২১ আগস্টের ঘটনায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান৷ তিনি বলেন, ‘‘রাজনীতিতে এর মধ্য দিয়ে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে দূর হবার নয়৷ এটা আমাদের দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের বিভাজন তৈরি করেছে৷’’
তার মতে, সরকার ও রাষ্ট্রের মদদে প্রতিপক্ষকে হত্যার রাজনীতি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না৷ ‘‘এই নির্মূল করার রাজনীতির মতো জঘন্য ঘটনা বড় ধরনের নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে,’’ বলেন তিনি৷ এই ঘটনায় যারা ভুক্তভোগী সেই আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় এসে বিরোধী মত ও রাজনীতি দমনের পথ থেকে সরে আসেনি বলে মনে করেন তিনি৷
‘‘তারপরও এখনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে৷ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের ঘটনা ঘটছে৷ আমাদের জাতীয় প্রয়োজনেই এসব বন্ধ হওয়া দরকার,” মনে করেন এই অধ্যাপক৷
মামলা ও রায়ের পটভূমি
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের মোট ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন৷ আহত হন পাঁচ শতাধিক৷ শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও কানে তখন গুরুতর আঘাত পান৷ ওই সময় নেতা-কর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে তাকে রক্ষা করেছিলেন৷ ওই ঘটনায় তখনকার বিএনপি-জামায়াত সরকারের পক্ষ থেকে মামলা ও তদন্ত ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ৷ জজ মিয়া নামে একজনকে দিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নিয়ে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়, যা জজ মিয়া নাটক নামে আলোচিত হয়৷ ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় মামলার তদন্ত নতুন মোড় নেয়৷ ওই সময় মামলার চার্জশিট দেয়া হয়৷ আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর মামলার অধিকতর তদন্ত করে সম্পূরক চার্জশিট দেয়৷
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর গ্রেনেড হামলার হত্যা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন আদালত৷
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফজ্জমান বাবর, এনএসআই'র সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, শেখ আবদুস সালাম, বিএনপি নেতা ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুল সালাম পিন্টুও রয়েছেন।
অন্যদিকে তারেক রহমান ছাড়াও যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ৷
মামলায় মোট আসামি ছিলেন ৫২ জন৷ এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোটের মন্ত্রী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলমের অন্য মামলায় গ্রেনেড মামলার রায়ের আগেই ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
ওই ঘটনায় বিস্ফোরক আইনেও তখন আরেকটি মামলা হয়৷ ওই মামলায়ও এই ব্যক্তিদের একই রকম শাস্তি দেন আদালত৷