হামলাকারীরা ‘মুক্ত', সাতবারেও জামিন পাননি ঝুমন দাস
৯ আগস্ট ২০২১এই বছরের ১৭ মার্চ সকালে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হাবিবপুর ইউনিয়নের নোয়াগাঁওয়ে সংখ্যালঘুদের গ্রামে হামলা চালানো হয়। ওই গ্রামের ঝুমন দাস নামে একজন হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে এমন অভিযোগ তুলে ওই হামলা চালানো হয়। হামলা এড়াতে একদিন আগে ১৬ মার্চই ঝুমন দাসকে পুলিশ হেফাজতে দেন ওই গ্রামের সংখ্যালাঘুরা। তখন থানা পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা গ্রামের বাসিন্দাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তারপরও পরের দিন সকালে পুরো গ্রামে পরিকল্পিত হামলা ও লুটপাট চালানো হয়। হামলার ঘটনায় শাল্লা থানায় অজ্ঞাত পরিচয়সহ মোট দেড় হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তাদের মধ্যে ৫২ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও সবাই এরইমধ্যে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
ঘটনার পাঁচ দিন পর পুলিশ হেফাজতে থাকা ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে জিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। এখনো কোনো তদন্ত প্রতিবেদন বা চার্জশিট দেয়া হয়নি। ঝুমন দাস জামিনও পাননি । তিনি পাঁচ মাস ধরে কারাগারে আছেন বলে জানান তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট দেবাংশু শেখর দাস।
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এ পর্যন্ত সাতবার জামিনের আবেদন করেছি। হাইকোর্টেও করেছি। কিন্তু জামিন হয়নি। হাইকোর্ট জামিন না দেয়ায় এখন আবার আইন অনুযায়ী নিম্ন আদালতে জামিন আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
হতাশা নিয়ে তিনি আরো বলেন, "মামলার তদন্ত শেষ হচেছ না, জামিনও পাচ্ছি না। মামলায় মামুনুল হকের বিরুদ্ধে কটুক্তি করায় ধর্ম অবমামনার অভিযোগ আনা হয়েছে।”
মামুনুল হকের বিরুদ্ধে মন্তব্য করা ধর্ম অমাননা কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "সেটা তো আইন আদালতের বিষয়। তবে ওই গ্রামে হামলা হয়েছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। এর সাথে ধর্ম অবমাননার কোনো সম্পর্ক নেই বলে মনে করি।”
মামুল হক নিজেও এখন কারাগারে আছেন। নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের সময় সারাদেশে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় ইন্ধন দেয়াসহ আরো কয়েকটি অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। হেফাজতের নতুন কমিটি থেকেও তাকে বাদ দেয়া হয়েছে।
ঝুমন দাসের স্ত্রী এবং ১১ মাস বয়সের একটি কন্যা শিশু রয়েছে। ঝুমন দাস কারাগারে থাকায় তারা নানা সংকটের মধ্যে রয়েছেন। ঝুমন দাসের স্ত্রী সুইটি রানী দাস বলেন, "মামুনুল হকের বিরুদ্ধে কিছু বললে তাতে ধর্মের অবমাননা হয় কীভাবে? সরকারেরও তো অনেক মন্ত্রী এমপি মামুনুল হকের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাহলে তারাও তো অপরাধ করেছেন। তাদের কেন গ্রেপ্তার করা হয় না? আমিও বলেছি, আমাকেও গ্রেপ্তার করা হোক।”
তিনি আরো বলেন, ‘‘ যারা হামলা করলো তাদের সবাই জামিন পেয়ে মুক্ত হয়ে গেল। কিন্তু আমার স্বামী ঝুমন দাস জামিন পান না। তাকে এখনো কারাগারে রাখা হয়েছে। এটা কেমন বিচার? কেমন আইন?”
এদিকে হিন্দু ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় ডিজিটাল আইনে মামলা হয়েছে। তিনি এখন কোভিড আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ও মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন," আমি যে পোস্টটি দিয়েছিলাম তা বহুল ব্যবহৃত একটি কৌতুক। এটি আমার বাননো না। বিভিন্ন উৎসে এটা পাওয়া যায়। তারপরও বিষয়টি নিয়ে ধর্মীয় অনুভূতির ব্যাপারটি আমাকে জানানো হলে আমি পোস্টটি প্রত্যাহার করি এবং কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগে থাকলে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি।”
তিনি জানান, ‘‘এই ঘটনায় প্রথমে থানায় জিডি ও পরে মামলা হয়। আমি কাউকে হেয় বা কোনা অসৎ উদ্দেশ্যে পোস্টটি দেইনি। আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। আমার এটা ভুল। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আমি ক্ষমা চেয়েছি, পোস্ট প্রত্যাহার করেছি। তারপরও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা উদ্দেশ্যমূলক।” তিনি আইনগতভাবেই বিষয়টি মেকাবেলার কথা জানান।
তিনি বলেন, "আমি মনে করি একটি চক্র উদ্দেশ্যমূলভাবে আমাকে হয়রানি করতে এই মামলা করেছে। আমাকে যদি হয়রানি করা হয়, তাহলে আইনের একজন অধ্যাপক হিসেবে এর বিরুদ্ধে আমি আইনসঙ্গতভাবে লড়াই করবো। ”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ মনে করেন, " আইনে ধর্ম অবমাননার কোনো ব্যাখ্যা না থাকায় এর অপব্যবহার হচ্ছে। হয়রানি বা অসৎ উদ্দেশ্যে আইনটি ব্যবহার করা হচ্ছে।”
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনের বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে বলেন, "তিনি পোস্টটি প্রত্যাহার করেছেন, ক্ষমা চেয়েছেন। তারপরও তার বিরুদ্ধে মামলা করা উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে হয়। আর আমাদের দেশে ধর্ম নিয়ে আমরা তো সাধারণ সমালোচনামূলক কথা বলি। সাহিত্য, কাব্য, কৌতুকেও এটা হয়। কার্জন সাহেব তো একটি কৌতুক পোস্ট দিয়েছিলেন।”
ঝুমন দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, " তিনি তো একজন ব্যক্তির (মামুনুল হক) বিরুদ্ধে পোস্ট দিয়েছিলেন। তাতে ধর্মের অবমাননা হয় কীভাবে?”
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন," ঝুমন দাস কী করছেন তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু ধর্ম অবমাননার নামে তাকে মাসের পর মাস কারাগারে থাকতে হচ্ছে। হামলকারীরা জামিনে মুক্তি পেয়েছে। এখানে আইনের ন্যায় প্রয়োগ দেখছি না। তার মামলা প্রত্যাহার হতে পারতো। আর অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন একটি কৌতুক প্রকাশ করেছেন। তারজন্য ক্ষমাও চেয়েছেন। তারপরও তার বিরুদ্ধে মামলা নেয়ায় আইনের ব্যত্যয় হয়েছে বলে মনে করি।”