একজন সংবাদকর্মী হিসেবে পেশাগত কারণেই ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকে এ বিষয়ে খবরগুলো গভীর মনযোগে দেখছিলাম৷ ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আক্রমণ করার প্রায় দুই মাস আগে থেকে সীমান্তে সেনা জড়ো করছিল রাশিয়া৷ যা দেশটির পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা ছিল৷ কিন্তু ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ ছাড়া আর কোনো বিশ্বনেতা বিষয়টিকে অতটা গুরুত্ব দিয়েছিল বলে আমার মনে হয়নি৷
রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণের কারণ স্পষ্ট করেই জানিয়েছিল৷ কেইবা চায় প্রতিবেশীর ঘরে শত্রুর বসতি হোক৷ তাই ইউক্রেন যখন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দিতে চাইলো, তখন রাশিয়া তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হলো৷ পূর্ব ইউরোপে ন্যাটের সম্প্রসারণ নিয়ে রাশিয়া অবশ্য আগে থেকেই জোর আপত্তি জানিয়ে আসছিল৷
১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং আরো ১১টি দেশ (যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইটালি, কানাডা, নরওয়ে, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, আইসল্যান্ড এবং লুক্সেমবার্গ) মিলে নর্থ আটল্যান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটো গঠন করে৷
১২ সদস্যের ন্যাটো এখন ৩০ সদস্যে পৌঁছেছে৷ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ন্যাটোর সীমান্ত মস্কোর দিকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার অগ্রসর হয়েছে৷ তাই রাশিয়ার আশঙ্কা একেবারে অমূলক বলার সুযোগ নেই৷
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা কিন্তু চাইলে আলোচনার টেবিলে রাশিয়ার ওই শঙ্কা দূর করে বিরোধ মেটাতে পারতো৷ আমার অন্তত তাই মনে হয়৷ কিন্তু তারা সেটা করেনি৷ রাশিয়ার আক্রমণের পর এখন ইউক্রেনও ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার আগ্রহ হারিয়েছে৷ তাহলে কেনো এই যুদ্ধ?
যুক্তরাষ্ট্র হয়তো চিরশত্রু রাশিয়াকে একটি যুদ্ধে জড়িয়ে সামরিক দিক দিয়ে দুর্বল করে দিতে চেয়েছিল৷ অন্যদিকে, ন্যাটোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যে প্রশ্ন গত কয়েক বছর ধরে উঠেছিল সেটাও এবার বন্ধ হবে৷ ন্যাটোর মাধ্যমে ইউরোপের উপর যুক্তরাষ্ট্র নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে চায়৷
যুক্তরাষ্ট্রের এই কূটনীতির বলির পাঁঠা হয়েছে ইউক্রেন৷ শুধু কী ইউক্রেন, নাকি পুরো বিশ্ব৷ বিপদে পড়েছে রাশিয়াও৷
খোদ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনও হয়তো ভাবেননি ইউক্রেন যুদ্ধ এত দীর্ঘায়িত হবে৷ সামরিক শক্তির বিচারে নেহাতই শিশু ইউক্রেন এভাবে ঘুরে দাঁড়াবে৷ এ যুদ্ধের কারণে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে রাশিয়া৷
এদিকে, এই যুদ্ধ বিশ্ব কূটনীতিকে নতুন পথে চালিত করেছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরব এখন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী হয়ে উঠেছে৷ তাইতো ওয়াশিংটনের ঘোর আপত্তি স্বত্তেও দেশটি তেল উৎপাদনকারী দেশের জোট ওপেক প্লাসকে নিয়ে তেল উৎপাদন কমিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ যা রাশিয়ার পক্ষে গেছে৷
ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে রাশিয়ার তেলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটির অর্থনীতি ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব৷
ওই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মূল্যছাড়ের সুযোগ নিয়ে চীন ও ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে এ বছর কয়েকগুণ বেশি তেল কিনেছে৷ রাশিয়ার সঙ্গে চীনের মিত্রতা দীর্ঘদিনের৷ কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে এক্ষেত্রে নামতে হয়েছে কূটনীতির জটিল খেলায়৷ যুক্তরাষ্ট্র-ভারত অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু৷ এদিকে, রাশিয়ার সঙ্গেও সুসম্পর্ক ভারতের৷ ভারত সরকার অবশ্য বলছে, তাদের কাছে দেশের স্বার্থ সবার আগে৷ তাই কোনো পক্ষ নিয়ে নয় বরং দেশের স্বার্থে তারা রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বাড়িয়েছে৷
ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই এবছর আরো একটি যুদ্ধের আশঙ্কার কালো মেঘ আকাশ ছেয়ে ফেলেছিল৷ অগ্রীম ঘোষণা ছাড়াই গত অগাস্টের শুরুর দিকে তাইওয়ান সফরে যান যু্ক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি৷ যার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় চীন৷ যার জের এখনো চলছে৷ ২৫ ডিসেম্বরও চীনের কয়েকডজন যুদ্ধবিমান ও ড্রোন তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে এবং সেদিনই চীন সরাসরি বলেছে, এটা তাদের ‘হামলার মহড়া' ছিল৷
তাই শুধু দীর্ঘায়িত ইউক্রেন যুদ্ধই নয় বরং কূটনীতির ব্যর্থতায় আরো একটি যুদ্ধ বেধে যাওয়ার শঙ্কা নিয়েই নতুন বছরে পা রাখছে বিশ্ব৷
যেমন করে কূটনৈতিক ব্যর্থতায় ভেস্তে যেতে বসেছে ইরান পরমাণু চুক্তি৷ তেহরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখতে ২০১৫ সালে যে চুক্তি হয়েছিল তার অস্তিত্ব এখন কেবলই কাগজেকলমে৷ বরং ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু' এই প্রবাদকে সত্য প্রমাণ করে ইরান ও উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হচ্ছে৷ যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে অস্ত্রের যোগান দিচ্ছে ইরান ও উত্তর কোরিয়া৷ বিনিময়ে রাশিয়া তাদের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে৷
উত্তর কোরিয়া তো এ বছরই নিজেদের পরমাণু শক্তিধর দেশ বলে ঘোষণা দিয়েছে৷ রেকর্ড সংখ্যায় ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে৷ রাশিয়ার প্রযুক্তি সহায়তা পেলে ইরানের হাতেও পরমাণু অস্ত্র পৌঁছে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না৷
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে চলে গেছে তুরস্ক৷ যারা এতদিন ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে অপাঙক্তেয় হয়েছিল৷ ন্যাটোর সদস্য হলেও তুরস্ক রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে৷ ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান যোগ্য লোক বলেই আমার মনে হয়৷ ফলে ইউরোপের কাছে হঠাৎ করেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন এই ‘একনায়ক'৷ ইউক্রেন যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বিপদ যে ইউরোপের৷
বিশ্ব কূটনীতি মত এ বছর বাংলাদেশের কূটনীতিতেও বেশ টানাপোড়েন দেখা গেছে৷
বিশেষ করে বছরের একেবারে শেষদিকে এসে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিচার হাসকে নিয়ে ওয়াশিংটন-ঢাকা-মস্কো কূটনৈতিক নাটক বেশ জমে গেছে এবং এর মূল কারণ বাংলাদেশের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন বলেই আমার মনে হয়েছে৷
বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আসন্ন৷ নির্বাচন ঘিরে প্রধান দুইদল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশজুড়ে জনসংযোগ করছে৷ নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তত ঘোলাটে হচ্ছে৷ বিশ্বমোড়লদের হস্তক্ষেপের খেলাও শুরু হয়ে গেছে৷
পিটার হাস ডিসেম্বরে বিএনপির নিখোঁজ নেতা সাজেদুল ইসলামের বাসায় গেলে একদল লোক তাকে ঘিরে ধরে৷ নিরাপত্তা উদ্বেগে তিনি বৈঠক অসম্পূর্ণ রেখেই সেখান থেকে বেরিয়ে যান৷
পরে যুক্তরাষ্ট্রের নানা পর্যায় থেকে হাসের নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশের নানা পর্যায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়৷
এদিকে, পিটার হাসের এভাবে বিএনপি নেতার বাসায় যাওয়া পছন্দ হয়নি সরকার দলীয় কয়েকজন মন্ত্রী ও নেতার৷ তারা এ ঘটনাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বলে মন্তব্য করে বসেন৷ সেই সুযোগে দৃশ্যপটে হাজির হয় ঢাকাস্থ রুশ দূতাবাস৷ লম্বা বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপকে আধিপত্যবাদী বৈশ্বিক রাজনীতির প্রকাশ বলে অভিযোগ করে৷ বাংলাদেশসহ অন্য যেকোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাশিয়া হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে বদ্ধপরিকর বলেও জানায়৷ অথচ, তারাই কিন্তু প্রতিবেশী দেশে আক্রমণ করেছে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছে৷
বছরের প্রথমার্ধে জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টারকে নিয়ে যে হইচই হয়েছিল তার কারণও অনেকটাই নির্বাচন৷ গত এপ্রিলে ট্র্যোস্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন৷ সেখানে তিনি বলেছিলেন, ট্র্যোস্টার বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্র পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন৷ এর মাধ্যমে বিএনপি হয়তো জার্মানির সমর্থন তাদের দিকে এটা বোঝাতে চেয়েছিল৷ কিন্তু তাতে পানি ঢেলে দেন খোদ জার্মান রাষ্ট্রদূত৷ পরে একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, তাকে নিয়ে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে তিনি অসন্তুষ্ট৷ কারণ, তারা তার বক্তব্য ঠিকভাবে উপস্থাপন করেনি৷
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অনেক কিছুর জন্য বহির্বিশ্বের উপর নির্ভর করতে হয়৷ ফলে রাজনীতিতে দেশের বাইরের হস্তক্ষেপও অনেক বেশি৷ নির্বাচনের আগে দিয়ে যেগুলো প্রকট হয়ে ওঠে৷
ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের অবস্থান দিনদিন গুরুত্ববহ হয়ে উঠছে বলে আমার মনে হয়৷ আঞ্চলিক দুই প্রতিপক্ষ চীন এবং ভারত উভয় বাংলাদেশকে পাশে চায়৷মহামন্দার চোখ রাঙানি নিয়ে শুরু হচ্ছে নতুন বছর৷ মন্দার ঝড় সামাল দিতে আঞ্চলিক দুই শক্তি চীন ও ভারত উভয়কে পাশে প্রয়োজন বাংলাদেশের৷ সঙ্গে নির্বাচনের বছরের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলাকেও সামাল দিতে হবে৷ রোহিঙ্গা ইস্যুও ঘাড় থেকে নামানো যাচ্ছে না৷ কূটনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আসছে বছরে তাই অনেক মেপে পা ফেলতে হবে৷