হরতালের আগুন
১৫ নভেম্বর ২০১৩কে, কখন মারা যান তা নিয়ে ভয়৷ চিকিৎসকরা আশ্বাস দিচ্ছেন৷ সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন৷ তবুও আশঙ্কা রয়ে গেছে৷ তাই বার্ন ইউনিটে রোগীদের আত্মীয়-স্বজনরা এখন সারাক্ষণ প্রার্থনা করছেন তাঁদের প্রিয়তমের প্রাণের জন্য৷
১০ নভেম্বর হরতালের রাতে মন্টু চন্দ্র পাল (৩৫) একটি লেগুনায় (হিউম্যান হলার) করে পুরান ঢাকা থেকে তাঁর বাসা নারায়ণগঞ্জে ফিরছিলেন৷ লক্ষ্মীবাজারের কাছে হরতাল সমর্থকরা লেগুনায় আগুন দিলে অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে মন্টুও অগ্নিদগ্ধ হন৷ তাঁকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে৷ মন্টু শুক্রবার মারা যান৷ বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক ডা. পার্থ শংকর পাল ডয়চে ভেলেকে জানান, মন্টুর শরীরের প্রায় ৯০ ভাগ পুড়ে গিয়েছিল৷ তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল৷ কিন্তু তাঁদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে৷
মন্টুর স্ত্রী মঞ্জু পাল গত ৫ দিন হাসপাতালেই ছিলেন৷ আহত স্বামীকে ছেড়ে তিনি কোথাও যাননি৷ কিন্তু স্বামী তাঁকে শেষ পর্যন্ত ছেড়ে গেল৷ তাঁর শোক আর বিলাপে শুক্রবার হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে৷ তাঁর একটিই প্রশ্ন, কেন মন্টুকে রাজনীতির বলি হতে হলো? সে জানায়, মন্টু পুরনো ঢাকায় একটি সোনার দোকানে কাজ করত৷ তাঁর আয়েই তাঁদের সংসার চলত৷ এখন সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই৷
একইভাবে গত কয়েক দিনে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন গার্মেন্টস কর্মী নাসিমা বেগম, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী মোস্তাফিজুর রহমান, কিশোর মনির হোসেন এবং বোমার কারিগর বলে পরিচিত আবুল কাশেম৷
পোশাক কর্মী নাসিমা বেগম কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে হরতালের আগুনের শিকার হন৷ বাসে করে বাসায় ফেরার সময় মোহাম্মদপুর এলাকায় বাসে আগুন দেয়া হলে তিনি অগ্নিদগ্ধ হন৷ নাসিমা মারা যান বুধবার৷ তাঁর বড় বোন রহিমা বেগমও পোশাক কারখানায় কাজ করেন৷ তাঁদের গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জে৷ রহিমা জানান তাঁর বোন নিজের পায়ে দাঁড়াতে ৬ মাস আগে ঢাকায় এসে পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছিল৷ নাসিমার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় সে প্রতিবাদী হয়ে ঢাকায় আসে৷ কিন্তু তাঁকে শেষ পর্যন্ত হরতালের আগুন বাঁচতেই দিল না৷ নাসিমার মৃত্যুর দিন তাঁর বোন রহিমা হাসপাতালে চিৎকার করে বলেন, ‘‘হরতালে ক্ষতি হয় গরিবের, মরলেও গরিব মরে, নেতাগো কিছু হয় না৷''
এপর্যন্ত ৩ সপ্তাহের হরতালে ঢাকায় ককটেল এবং যানবাহনে আগুন দেয়ায় ৭৮ জন অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন৷ ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে এখন ২৮ জন চিকিৎসাধীন আছেন৷ ডা. পার্থ শংকর পাল জানান, যাঁরা অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন তাঁদের সবাই নিম্নবিত্তের৷ আর তাঁদের অনেকেই এখনো আশঙ্কামুক্ত নন৷ তিনি বলেন শরীরের ৪০ ভাগের বেশি পুড়লেই কাউকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন৷ এখন যাঁরা চিকিৎসাধীন আছেন তাঁদের বেশিরভাগেরই ৪০ ভাগের বেশি পুড়েছে৷ তাঁরা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছেন সুস্থ করতে৷ এজন্য বার্ন ইউনিটের সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে৷ তাঁর আশঙ্কা, যাঁরা বেঁচে থাকবেন তাঁদের বড় একটি অংশ পঙ্গু হয়ে যাবে৷
এদিকে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আহতদের প্রতিটি ক্ষণ এখন কাটছে আতঙ্ক আর ভয়ে৷ কোনো খবর শুনলেই তাঁরা দৌড়ে যান৷
আগুনে পোড়া ইব্রাহিমের স্ত্রী জানান, তিনি এখন দিন-রাত শুধু প্রার্থনা করছেন তাঁর স্বামী যেন সুস্থ হন৷ তাঁকে যেন আর কোনো খারাপ খবর শুনতে না হয়৷ গত সপ্তাহের হরতাল আপাতত শেষ হলেও হরতালের ভয়াবহতার শিকার এই মানুষগুলোকে টানতে হচ্ছে হরতালের জের৷