পুড়ছে মানুষ, পুড়ছে স্বপ্নও
১৩ নভেম্বর ২০১৩গত তিন সপ্তাহে মোট ১০ দিন হরতাল পালন করল বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী ১৮ দলীয় জোট৷ এই হরতালকে কেন্দ্র করে শুধু ঢাকাতেই ককটেল আর যানবাহনে আগুনের শিকার হয়েছেন ৭৩ জন৷ নারী, শিশু, এমনকি প্রতিবন্ধীরাও রেহাই পাননি আগুন থেকে৷ তাঁদের কারুর পুরো শরীর ঝলসে গেছে৷ আবার কারুর গেছে হাত-পা৷ কারুর চোখ নষ্ট হয়েছে৷ কারু বা ঝলসে গেছে পুরো শরীর৷ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চিকিত্সক ডা. পার্থ শংকর পাল ডয়চে ভেলেকে জানান, এখন তাদের কাছে ২৪ জন চিকিত্সাধীন আছেন৷ হঠাত্ করে হরতালের কারণে পোড়া রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায়, তাঁরা তাঁদের চিকিত্সা দিতে হিমসিম খাচ্ছেন৷ তবে এটাই একমাত্র বিশেষায়িত চিকিত্সা কেন্দ্র হওয়ায়, তাঁরা রোগীদের অন্য কোনো হাসপাতালে পাঠাতেও পারছেন না৷ তাই মেঝেতে রেখে হলেও তাঁদের চিকিত্সা দেয়া হচ্ছে৷
যাঁরা আগুনে বা ককটেলে আহত হয়েছেন, তাঁদের সবার করুণ কাহিনি প্রায় একই রকম৷ হরতালে বাস বা অন্য কোনো যানবাহনের যাত্রী হিসেবে আগুনের শিকার হয়েছেন তাঁরা৷ কোথাও বা বাসে সরাসরি আগুন দেয়া হয়েছে৷ কেউ আহত হয়েছেন যাত্রাবাড়িতে, কেউ সায়েদাবাদ, কেউ মহাখালি আবার কেউবা শিকার হয়েছেন মিরপুর এলকায়৷ আহতদের কাছ থেকে জানা যায়, বাসে আগুন বা ককটেল-বোমা ছোড়া হয় হঠাত্ করে৷ তবে যাত্রী হিসেবে বাসে উঠেও আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে৷ এরা যাত্রীদের নামারও সময় দেয় না৷
বার্ন ইউনিটে যন্ত্রণায় কাতর তারেক আহমেদ জানান, তিনি বাসের মাঝের সিটে ছিলেন৷ অনেক যাত্রী দ্রুত নেমে গেলেও তিনিসহ কয়েকজন আর নামতে পারেননি৷ আগুন তাঁদের গ্রাস করেছে৷ পুরনো ঢাকায় সন্ধ্যার পর একটি লেগুনায় (হিউম্যান হলার) পেট্রোল-বোমা ছুড়ে মারা হলে, রবিবার রাতে ছয়জন যাত্রীই অগ্নিদগ্ধ হন৷ তাঁদের একজন আবুবকর সিদ্দিক জানান, তিনি ভাবতেও পারেননি যে তাঁর জীবনে এমন বিপর্যয় নেমে আসবে৷ তাঁর জীবনের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে এভাবে৷
যাঁরা পুড়ে গেছেন, তাঁদের আত্মীয়স্বজনও এখন দিশেহারা৷ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী খলিলের স্ত্রী শাহানা বেগমের কান্না যেন থামছে না৷ কারণ. গুরুতর আহত খলিল শেষ পর্যন্ত বাঁচবেন কিনা তা বলা যাচ্ছে না৷ আর বাঁচলেও কর্মক্ষম থাকার আশা খুবই কম৷ শাহানা বেগম জানান, হরতালের আগুনে শুধু তাঁর স্বামীই পোড়েননি, পুড়েছে তাঁদের গোটা সংসার৷
ডা. পার্থ শংকর পাল জানান, যাঁরা এখনো হাসপাতালে ভর্তি আছেন তাঁদের শরীরের ২৫ ভাগের বেশি পুড়ে গেছে৷ তাঁদের অবস্থা সত্যিই আশঙ্কাজনক৷ তিনি জানান, তাঁদের বড় একটি অংশ সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন৷ কয়েকজনের চোখ নষ্ট হয়ে গেছে৷ তাঁদের জন্য সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই৷
হরতালে এই নৃশংসতার জন্য বিরোধী দল দায়ী করছে সরকারকে৷ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন, সরকারের লোকজন এই সব ঘটনা ঘটিয়ে বিরোধী দলের ওপর দায় চাপাচ্ছে৷ অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার কথা বলেছেন৷
এরপরও সামনের সপ্তাহে আবারও হরতাল ঘোষণা করা হয়েছে৷ নেতারা হরতালে মাঠে না থাকলেও ককটেল আর আগুন যে থাকবে, তা বলা যায় প্রায় নিশ্চিত করেই৷ বলা বাহুল্য, বার্ন ইউনিটে আরো বাড়বে আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা৷ পুড়বে মানুষ, পুড়বে সংসার, পুড়বে কপাল৷