1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘সেই শেখ হাসিনা’র আমলে গুম নিয়ে বাংলাদেশকে কথা শুনতে হয়!

প্রভাষ আমিন
১৯ আগস্ট ২০২২

অনেক সমালোচনা আছে, তারপরও ভালোমন্দ মিলিয়ে শেখ হাসিনা আমার প্রিয়৷ শেখ হাসিনাকে পছন্দ করার অনেকগুলো কারণ আছে৷ তবে তালিকার ওপরের দিকে থাকা দুটি কারণই বিচার সংশ্লিষ্ট৷

https://p.dw.com/p/4FnTw
Bangladesch Demo Internationale Woche der Verschwundenen
ছবি: Md. Rakibul Hasan/ZUMA Press Wire/picture alliance

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে৷ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যাবে না বলে একটি অধ্যাদেশ জারি করেন৷ বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল সুবিধাভোগী জিয়াউর রহমান সেই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করেন৷ এরপর আত্মস্বীকৃত খুনিরা দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ান মুক্ত বিহঙ্গের মতো, নাম লেখান রাজনীতিতেও৷ বঙ্গবন্ধুর হত্যার ২১ বছর পর তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে৷ চাইলে শেখ হাসিনা পিতা হত্যার ‘প্রতিশোধ’ নিতে পারতেন৷  চাইলে শেখ হাসিনা খুনিদের ‘ক্রসফায়ারে' দিতে পারতেন৷ জিয়া যেভাবে সংক্ষিপ্ত আদালতে, সংক্ষিপ্ততম সময়ে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন, চাইলে শেখ হাসিনাও তেমন কোনো দ্রুত আদালতে বিচার করে দ্রুততম সময়ে খুনিদের ফাঁসিতে লটকাতে পারতেন৷ তিনি তার কিছুই করেননি৷ শেখ হাসিনা প্রথমে সংবিধান থেকে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামের কালো অধ্যায়টি মুছে ফেলেন৷ বিচারের আইনি বাধা অপসারণের পরই বঙ্গবন্ধু হত্যার মামলা, তদন্ত, বিচারকাজ শুরু হয়৷ সবকিছু হয়েছে স্বাভাবিক আদালতে, স্বাভাবিক সময়ে৷ এমনকি ৫ বছর ক্ষমতায় থেকেও শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা শেষ করতে পারেননি৷ এই মামলার রায় কার্যকরে শেখ হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় আসতে হয়েছে৷ কারণ, বিএনপি ক্ষমতায় এসে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার বিচার আপিল পর্যায়ে থাকা অবস্থায় ডিপফ্রিজে পাঠিয়ে দেয়৷ বিএনপি আমলে মামলার এক ইঞ্চিও অগ্রগতি হয়নি৷ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরতে না পারলে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা এখনও বেঁচে থাকতে পারতো৷ আওয়ামী লীগ গত ১৩ বছর ক্ষমতায়, তারপরও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কেউ কেউ ফাঁসির দণ্ড মাথায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডায়, লিবিয়ায়, পাকিস্তানে ঘুরে বেড়ায়৷ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া আমাকে শেখ হাসিনাকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছে, শ্রদ্ধা করতে শিখিয়েছে৷ সব সুযোগ থাকার পরও শেখ হাসিনা পিতা হত্যার ‘প্রতিশোধ' নেননি, তিনি জাতির জনকের হত্যার বিচার করে জাতিকেই তিনি গ্লানিমুক্ত করেছেন৷ গোটা বিশ্বকে দেখিয়েছেন প্রতিশোধ আর বিচারের পার্থক্য৷ জাতিকে মুক্ত করেছেন ইনডেমনিটির কলঙ্ক থেকে৷

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পর শেখ হাসিনা জাতিকে আরেকটি গ্লানি থেকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেন৷ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য তিনি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন৷ চাইলে শেখ হাসিনা চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদেরও ‘ক্রসফায়ারে' দিতে পারতেন বা বিচারের নামে প্রহসন করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে তাদের ফাঁসি দিতে পারতেন৷ কিন্তু তিনি তেমন কিছু করেননি৷ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মতো যুদ্ধাপরাধীরাও আইনের সর্বোচ্চ সুরক্ষা পেয়েছে৷ রায়, আপিল, রিভিউ, রাষ্ট্রপতির কাছে মার্জনার আবেদন নিষ্পত্তির পরই তাদের দণ্ড কার্যকর হয়েছে৷

আইনের শাসন, বিচার প্রক্রিয়া এবং মানবাধিকারকে এমন উচ্চ মানদণ্ডে তুলে দেয়াই শেখ হাসিনাকে পছন্দের প্রধান কারণ৷ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ভুলে বিচার প্রক্রিয়ায় আস্থা রাখার এমন উদাহরন বিরল৷ কিন্তু গভীর বেদনার বিষয় হলো, সেই শেখ হাসিনার শাসনামলেই বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি কথা শুনতে হয় মানবাধিকার, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে৷ বর্তমানে বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যার যে ধারাটি প্রচলিত, তার শুরুটা হয়েছিল বিএনপি আমলে৷ প্রথমে অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় ‘হার্ট অ্যাটাক বেড়ে যাওয়া’ আর পরে র‍্যাব গঠনের মাধ্যমে ক্রসয়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়৷ শুরুতে বিষয়টি বেশ জনপ্রিয়তা পায়৷ তখন বিরোধী দলে থাকা শেখ হাসিনা ক্রসফায়ারের বিরোধিতা করেছিলেন৷ কিন্তু বেদনার বিষয় হলো, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে বিএনপির এই অপকর্মের ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন৷ একই সঙ্গে দেশে ‘বিচার’ এবং ‘বিচার বহির্ভূত’ দুটি ধারাই প্রবহমান৷ বর্তমান সরকারের আমলে বিচার বহির্ভূত ধারায় ক্রসফায়ারের সাথে যুক্ত হয়েছে গুম, মানে মানুষের হারিয়ে যাওয়া৷ যখন ক্রসফায়ার নিয়ে অনেক সমালোচনা হতো, তখন বেড়ে যেতো গুম৷ দুটিই বিচারবহির্ভূত হলেও ক্রসফায়ারের জন্য র‍্যাব বা পুলিশকে মিথ্যা হলেও একটা প্রেস রিলিজ দিতে হতো৷ কিন্তু গুমের ক্ষেত্রে শুধু অস্বীকার করলেই চলে৷ স্বজনদের বিবেচনায় দুটিতে পার্থক্য হলো, ক্রসফায়ার হলে তবু মৃত্যুবার্ষিকী থাকে, কবর থাকে; গুমে থাকে শুধু অনন্ত অপেক্ষা আর কান্না৷

বর্তমান সরকারের আমলে হারিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা নিয়ে অনেকের অনেক পরিসংখ্যান দেখেছি৷ সংখ্যাটা কয়েকশ হবে৷ তবে মানুষের হারিয়ে যাওয়ার নানা কারণ থাকে৷ ছেলেবেলায় আমার ছোট চাচা হারিয়ে গিয়েছিলেন৷ ছোট সন্তানের জন্য আমার দাদীর কান্না আর ছোট ভাইকে খুঁজতে আমার বাবার চেষ্টা দেখেছি ছেলেবেলা থেকেই৷ বছর বিশেক পর চাচার খোঁজ মেলে খুলনায়, সেখানে তিনি সংসার পেতেছিলেন৷ আমাদের পাশের বাড়ির এক চাচাতো ভাই রাস্তার মাটির কাজ করতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন৷ তার আর কোনো খোঁজ মেলেনি৷ আমাদের গ্রামের আরেক চাচা ২/৩ বছর নিখোঁজ থাকতেন৷ ইচ্ছা হলে বাড়ি ফিরে ২/৩ মাস থেকে আবার হারিয়ে যেতেন৷ ছেলেবেলা থেকেই পত্রিকায় সচিত্র নিখোঁজ সংবাদ ছাপা হতে দেখেছি৷ পাড়ায়-মহল্লায় সন্ধান চেয়ে মাইকিংও শুনেছি অনেক৷ হারিয়ে যাওয়া, পালিয়ে যাওয়া, বাউন্ডুলে, ছেলেধরার সাথে এখন হারিয়ে যাওয়ার আরো অনেক কারণ যুক্ত হয়েছে৷ অপহরণ, মুক্তিপণ, শত্রুতা, পাওনাদারের ভয়, মামলার ভয়, শত্রুকে বিপদে ফেলা ইত্যাদি নানা কারণেও মানুষ ‘হারিয়ে যায়’৷ বাড়ি থেকে পালিয়ে জঙ্গি নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়া, এমনকি সিরিয়ায় চলে যাওয়ার উদাহরনও কম নয়৷ গুম নিয়ে আলোচনা উঠলেই সরকারের মন্ত্রীরা খুব ইনোসেন্টলি এসব উদাহরন সামনে আনেন৷ আমরাও বুঝে হোক বা বোঝার ভাণ করে হোক; তা মেনে নেই৷ কিন্তু আমরাও বুঝি, মন্ত্রীরাও বোঝেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বা জাতিসংঘ যে গুম নিয়ে উদ্বিগ্ন, তার সাথে এই নির্দোষ নিখোঁজের কোনো সম্পর্ক নেই৷ গুম মানে হলো কাউকে জোর করে তুলে নেয়া৷ আইন-শৃঙ্খলার বাহিনীর নামে সাদা পোষাকে তুলে নেয়া৷ সংখ্যাটা যা-ই হোক, ভিন্নমতের অনেক মানুষ যে এভাবে গুম হয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ হারিয়ে যাওয়ার অনেকে পরে ফিরে এসেছেন, অনেককে পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তারও দেখিয়েছে৷ তবে হারিয়ে যাওয়া অনেক মানুষের খোঁজ এখনও মেলেনি৷ আগেই বলেছি, গুমের ব্যাপারে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান বরাবরই অস্বীকারের৷ বড় জোর পুলিশ বলে, ‘‘আমরা তদন্ত করে দেখছি৷’’

প্রভাষ আমিন, সাংবাদিক ও লেখক
প্রভাষ আমিন, সাংবাদিক ও লেখকছবি: DW

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাচেলেটের সাম্প্রতিক সফরকে ঘিরে বিচার বহির্ভূত তৎপরতা, গুম নিয়ে নতুন করে আলোচনা হচ্ছে৷ একটি প্রবাসী অনলাইনের গুম সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও সে আলোচনায় হাওয়া দিচ্ছে৷ তবে মানতেই হবে, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো৷ বিশেষ করে টেকনাফে ক্রসফায়ারে মেজর (অব.) সিনহা হত্যার পর ক্রসফায়ার কমে আসে৷ আর র‍্যাব ও র‍্যাবের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার প্রশ্নে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর ক্রসফায়ার এবং গুম শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে৷ এই পরিস্থিতি খুবই স্বস্তিদায়ক৷ এই পরিস্থিতি ধরে রাখতে হবে এবং আরো উন্নতি ঘটাতে হবে৷ তবে যারা হারিয়ে গেছে, তাদের খুঁজে বের করার কাজটা চালিয়ে যেতে হবে৷ জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত সফর শেষের সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকলে তা অস্বীকার না করে সরকারকে আমলে নিতে বলেছেন৷ একই সঙ্গে এসব অভিযোগের সুরাহা করতে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন তিনি৷ আমি তার সাথে একমত৷ অস্বীকারেই দায়িত্ব শেষ করার প্রবণতা থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে৷ ধরে নিচ্ছি, কোনো গুমের সাথেই সরকারের বা কোনো বাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই৷ সাদা পোশাকে হয়ত দুর্বৃত্তরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ভাঙিয়েছে৷ কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো, হারিয়ে যাওয়া প্রতিটি মানুষকে খুঁজে বের করা৷ অস্বীকারেই সব দায় শেষ হয়ে যায় না৷

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও যুদ্ধাপরাধীদের স্বাভাবিক গতিতে বিচারের মাধ্যমে শেখ হাসিনা মানবাধিকারের যে উচ্চ মানদণ্ড স্থাপন করেছেন, আমাদের প্রত্যাশা বাংলাদেশ সেই মান ধরে রাখবে৷ হারিয়ে যাওয়া মানুষের স্বজনরা ‘মায়ের ডাক’ একটি সংগঠন গড়েছেন৷ সেই মায়েদের ডাক শোনার সংবেদনশীলতা সবচেয়ে বেশি আছে শেখ হাসিনারই৷ স্বজন হারানোর বেদনা তার চেয়ে ভালো করে আর কে বুঝবে! আর কোনো সন্তানহারা মায়ের কান্না যেন আমাদের না শুনতে হয়৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য