১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে৷ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যাবে না বলে একটি অধ্যাদেশ জারি করেন৷ বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল সুবিধাভোগী জিয়াউর রহমান সেই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করেন৷ এরপর আত্মস্বীকৃত খুনিরা দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ান মুক্ত বিহঙ্গের মতো, নাম লেখান রাজনীতিতেও৷ বঙ্গবন্ধুর হত্যার ২১ বছর পর তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে৷ চাইলে শেখ হাসিনা পিতা হত্যার ‘প্রতিশোধ’ নিতে পারতেন৷ চাইলে শেখ হাসিনা খুনিদের ‘ক্রসফায়ারে' দিতে পারতেন৷ জিয়া যেভাবে সংক্ষিপ্ত আদালতে, সংক্ষিপ্ততম সময়ে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন, চাইলে শেখ হাসিনাও তেমন কোনো দ্রুত আদালতে বিচার করে দ্রুততম সময়ে খুনিদের ফাঁসিতে লটকাতে পারতেন৷ তিনি তার কিছুই করেননি৷ শেখ হাসিনা প্রথমে সংবিধান থেকে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামের কালো অধ্যায়টি মুছে ফেলেন৷ বিচারের আইনি বাধা অপসারণের পরই বঙ্গবন্ধু হত্যার মামলা, তদন্ত, বিচারকাজ শুরু হয়৷ সবকিছু হয়েছে স্বাভাবিক আদালতে, স্বাভাবিক সময়ে৷ এমনকি ৫ বছর ক্ষমতায় থেকেও শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা শেষ করতে পারেননি৷ এই মামলার রায় কার্যকরে শেখ হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় আসতে হয়েছে৷ কারণ, বিএনপি ক্ষমতায় এসে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার বিচার আপিল পর্যায়ে থাকা অবস্থায় ডিপফ্রিজে পাঠিয়ে দেয়৷ বিএনপি আমলে মামলার এক ইঞ্চিও অগ্রগতি হয়নি৷ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরতে না পারলে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা এখনও বেঁচে থাকতে পারতো৷ আওয়ামী লীগ গত ১৩ বছর ক্ষমতায়, তারপরও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কেউ কেউ ফাঁসির দণ্ড মাথায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডায়, লিবিয়ায়, পাকিস্তানে ঘুরে বেড়ায়৷ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া আমাকে শেখ হাসিনাকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছে, শ্রদ্ধা করতে শিখিয়েছে৷ সব সুযোগ থাকার পরও শেখ হাসিনা পিতা হত্যার ‘প্রতিশোধ' নেননি, তিনি জাতির জনকের হত্যার বিচার করে জাতিকেই তিনি গ্লানিমুক্ত করেছেন৷ গোটা বিশ্বকে দেখিয়েছেন প্রতিশোধ আর বিচারের পার্থক্য৷ জাতিকে মুক্ত করেছেন ইনডেমনিটির কলঙ্ক থেকে৷
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পর শেখ হাসিনা জাতিকে আরেকটি গ্লানি থেকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেন৷ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য তিনি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন৷ চাইলে শেখ হাসিনা চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদেরও ‘ক্রসফায়ারে' দিতে পারতেন বা বিচারের নামে প্রহসন করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে তাদের ফাঁসি দিতে পারতেন৷ কিন্তু তিনি তেমন কিছু করেননি৷ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মতো যুদ্ধাপরাধীরাও আইনের সর্বোচ্চ সুরক্ষা পেয়েছে৷ রায়, আপিল, রিভিউ, রাষ্ট্রপতির কাছে মার্জনার আবেদন নিষ্পত্তির পরই তাদের দণ্ড কার্যকর হয়েছে৷
আইনের শাসন, বিচার প্রক্রিয়া এবং মানবাধিকারকে এমন উচ্চ মানদণ্ডে তুলে দেয়াই শেখ হাসিনাকে পছন্দের প্রধান কারণ৷ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ভুলে বিচার প্রক্রিয়ায় আস্থা রাখার এমন উদাহরন বিরল৷ কিন্তু গভীর বেদনার বিষয় হলো, সেই শেখ হাসিনার শাসনামলেই বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি কথা শুনতে হয় মানবাধিকার, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে৷ বর্তমানে বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যার যে ধারাটি প্রচলিত, তার শুরুটা হয়েছিল বিএনপি আমলে৷ প্রথমে অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় ‘হার্ট অ্যাটাক বেড়ে যাওয়া’ আর পরে র্যাব গঠনের মাধ্যমে ক্রসয়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়৷ শুরুতে বিষয়টি বেশ জনপ্রিয়তা পায়৷ তখন বিরোধী দলে থাকা শেখ হাসিনা ক্রসফায়ারের বিরোধিতা করেছিলেন৷ কিন্তু বেদনার বিষয় হলো, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে বিএনপির এই অপকর্মের ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন৷ একই সঙ্গে দেশে ‘বিচার’ এবং ‘বিচার বহির্ভূত’ দুটি ধারাই প্রবহমান৷ বর্তমান সরকারের আমলে বিচার বহির্ভূত ধারায় ক্রসফায়ারের সাথে যুক্ত হয়েছে গুম, মানে মানুষের হারিয়ে যাওয়া৷ যখন ক্রসফায়ার নিয়ে অনেক সমালোচনা হতো, তখন বেড়ে যেতো গুম৷ দুটিই বিচারবহির্ভূত হলেও ক্রসফায়ারের জন্য র্যাব বা পুলিশকে মিথ্যা হলেও একটা প্রেস রিলিজ দিতে হতো৷ কিন্তু গুমের ক্ষেত্রে শুধু অস্বীকার করলেই চলে৷ স্বজনদের বিবেচনায় দুটিতে পার্থক্য হলো, ক্রসফায়ার হলে তবু মৃত্যুবার্ষিকী থাকে, কবর থাকে; গুমে থাকে শুধু অনন্ত অপেক্ষা আর কান্না৷
বর্তমান সরকারের আমলে হারিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা নিয়ে অনেকের অনেক পরিসংখ্যান দেখেছি৷ সংখ্যাটা কয়েকশ হবে৷ তবে মানুষের হারিয়ে যাওয়ার নানা কারণ থাকে৷ ছেলেবেলায় আমার ছোট চাচা হারিয়ে গিয়েছিলেন৷ ছোট সন্তানের জন্য আমার দাদীর কান্না আর ছোট ভাইকে খুঁজতে আমার বাবার চেষ্টা দেখেছি ছেলেবেলা থেকেই৷ বছর বিশেক পর চাচার খোঁজ মেলে খুলনায়, সেখানে তিনি সংসার পেতেছিলেন৷ আমাদের পাশের বাড়ির এক চাচাতো ভাই রাস্তার মাটির কাজ করতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন৷ তার আর কোনো খোঁজ মেলেনি৷ আমাদের গ্রামের আরেক চাচা ২/৩ বছর নিখোঁজ থাকতেন৷ ইচ্ছা হলে বাড়ি ফিরে ২/৩ মাস থেকে আবার হারিয়ে যেতেন৷ ছেলেবেলা থেকেই পত্রিকায় সচিত্র নিখোঁজ সংবাদ ছাপা হতে দেখেছি৷ পাড়ায়-মহল্লায় সন্ধান চেয়ে মাইকিংও শুনেছি অনেক৷ হারিয়ে যাওয়া, পালিয়ে যাওয়া, বাউন্ডুলে, ছেলেধরার সাথে এখন হারিয়ে যাওয়ার আরো অনেক কারণ যুক্ত হয়েছে৷ অপহরণ, মুক্তিপণ, শত্রুতা, পাওনাদারের ভয়, মামলার ভয়, শত্রুকে বিপদে ফেলা ইত্যাদি নানা কারণেও মানুষ ‘হারিয়ে যায়’৷ বাড়ি থেকে পালিয়ে জঙ্গি নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়া, এমনকি সিরিয়ায় চলে যাওয়ার উদাহরনও কম নয়৷ গুম নিয়ে আলোচনা উঠলেই সরকারের মন্ত্রীরা খুব ইনোসেন্টলি এসব উদাহরন সামনে আনেন৷ আমরাও বুঝে হোক বা বোঝার ভাণ করে হোক; তা মেনে নেই৷ কিন্তু আমরাও বুঝি, মন্ত্রীরাও বোঝেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বা জাতিসংঘ যে গুম নিয়ে উদ্বিগ্ন, তার সাথে এই নির্দোষ নিখোঁজের কোনো সম্পর্ক নেই৷ গুম মানে হলো কাউকে জোর করে তুলে নেয়া৷ আইন-শৃঙ্খলার বাহিনীর নামে সাদা পোষাকে তুলে নেয়া৷ সংখ্যাটা যা-ই হোক, ভিন্নমতের অনেক মানুষ যে এভাবে গুম হয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ হারিয়ে যাওয়ার অনেকে পরে ফিরে এসেছেন, অনেককে পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তারও দেখিয়েছে৷ তবে হারিয়ে যাওয়া অনেক মানুষের খোঁজ এখনও মেলেনি৷ আগেই বলেছি, গুমের ব্যাপারে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান বরাবরই অস্বীকারের৷ বড় জোর পুলিশ বলে, ‘‘আমরা তদন্ত করে দেখছি৷’’
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাচেলেটের সাম্প্রতিক সফরকে ঘিরে বিচার বহির্ভূত তৎপরতা, গুম নিয়ে নতুন করে আলোচনা হচ্ছে৷ একটি প্রবাসী অনলাইনের গুম সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও সে আলোচনায় হাওয়া দিচ্ছে৷ তবে মানতেই হবে, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো৷ বিশেষ করে টেকনাফে ক্রসফায়ারে মেজর (অব.) সিনহা হত্যার পর ক্রসফায়ার কমে আসে৷ আর র্যাব ও র্যাবের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার প্রশ্নে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর ক্রসফায়ার এবং গুম শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে৷ এই পরিস্থিতি খুবই স্বস্তিদায়ক৷ এই পরিস্থিতি ধরে রাখতে হবে এবং আরো উন্নতি ঘটাতে হবে৷ তবে যারা হারিয়ে গেছে, তাদের খুঁজে বের করার কাজটা চালিয়ে যেতে হবে৷ জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত সফর শেষের সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকলে তা অস্বীকার না করে সরকারকে আমলে নিতে বলেছেন৷ একই সঙ্গে এসব অভিযোগের সুরাহা করতে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন তিনি৷ আমি তার সাথে একমত৷ অস্বীকারেই দায়িত্ব শেষ করার প্রবণতা থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে৷ ধরে নিচ্ছি, কোনো গুমের সাথেই সরকারের বা কোনো বাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই৷ সাদা পোশাকে হয়ত দুর্বৃত্তরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ভাঙিয়েছে৷ কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো, হারিয়ে যাওয়া প্রতিটি মানুষকে খুঁজে বের করা৷ অস্বীকারেই সব দায় শেষ হয়ে যায় না৷
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও যুদ্ধাপরাধীদের স্বাভাবিক গতিতে বিচারের মাধ্যমে শেখ হাসিনা মানবাধিকারের যে উচ্চ মানদণ্ড স্থাপন করেছেন, আমাদের প্রত্যাশা বাংলাদেশ সেই মান ধরে রাখবে৷ হারিয়ে যাওয়া মানুষের স্বজনরা ‘মায়ের ডাক’ একটি সংগঠন গড়েছেন৷ সেই মায়েদের ডাক শোনার সংবেদনশীলতা সবচেয়ে বেশি আছে শেখ হাসিনারই৷ স্বজন হারানোর বেদনা তার চেয়ে ভালো করে আর কে বুঝবে! আর কোনো সন্তানহারা মায়ের কান্না যেন আমাদের না শুনতে হয়৷