1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

স্বজন আর সরকারি ভাষ্যেই আটকে গণমাধ্যমে গুমের খবর

DW Mitarbeiterportrait | Tanjir Mohammad Mehedi Chowdhury
তানজীর মেহেদী
১৯ আগস্ট ২০২২

‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ অভিযোগ এনে র‌্যাবের সাবেক প্রধান, বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদসহ সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার৷

https://p.dw.com/p/4FlUu
গুম হওয়া এক ব্যক্তির পরিবারের স্বজন
ছবি: Md. Rakibul Hasan/ZUMA Press Wire/picture alliance

তারপর থেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কিংবা গুমের মতো বিষয়গুলো নিয়ে চর্চা শুরু হয়৷ যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়গুলো বরাবরই অস্বীকার করে আসা হচ্ছে৷

সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাচেলেট চার দিনের বাংলাদেশ সফরে আসাকে ঘিরে সেই আলোচনার পালে আবারও হাওয়া লেগেছে৷

সাধারণত কোনো ব্যক্তিকে কোনো মহল বা গোষ্ঠী কিংবা সংস্থা তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তার খোঁজ পাওয়া না গেলেই তাকে ‘গুম’ বলা হয়৷ তবে সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চর্চিত এই ‘গুম' শব্দটির ক্ষেত্রে একটি সংজ্ঞায়ন ঠিক করেছে জাতিসংঘ৷

বিশ্ব সংস্থার জাতিসংঘ বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক কোনো ব্যক্তিকে যদি বিচার ব্যবস্থার কাছে হাজির করা না হয় এবং তার যদি সন্ধান না মেলে সেটিকে গুম হিসেবে ধরা হয়৷

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র ২০২০ সালের ২৯ আগস্ট জানিয়েছিল, ২০০৭ থেকে ২০২০ সাল (২৫ আগস্ট) পর্যন্ত ১৪ বছরে দেশে ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন৷

গুম হওয়ার পর এদের মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে৷ ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ এদেরে মধ্যে ফেরত এসেছে ৫৭ জন৷ অন্যদের বিষয়ে সুর্নিদিষ্ট তথ্য গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়নি৷

গুমের সংখ্যাটি আঁতকে উঠার মতো হলেও আইন ও শালিস কেন্দ্রের গত আট বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে অবশ্য সেখানে কিছুটা হলেও স্বস্তি মেলে৷ তার কারণ গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে৷

প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দুই জন ব্যক্তির গুম হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷ যাদের মধ্যে একজন ফিরে এসেছেন৷ অপরজনের কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী৷

২০২১ সালে দেশে গুম হওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল সাত৷ যাদের মধ্যে ছয় জনের বিষয়ে মুখ খুলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী৷ আর একজনের বিষয়টি জানা যায়নি৷

প্রতিষ্ঠানটির ২০২০ সালের হিসাব বলছে, দেশে গুম হয়েছে ছয়জন৷ চারজনের কথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্বীকার করলেও দুই জন ছিলেন নিখোঁজের তালিকায়৷

২০১৯ সালে গুম হওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ১৩৷ চারজন ফিরে এসেছেন৷ একজনের বিষয় স্বীকার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী৷ আটজন ছিল নিখোঁজ৷

২০১৮ সালে গুমের সংখ্যা ছিল ৩৪৷ ২০১৭ সালে ছিল ৬০৷ ২০১৬ সালে ছিল ৯৭৷ ২০১৫ সালে ৫৫৷

গুম নিয়ে আলোচনা আসলেই সমালোচনার মুখে পড়ে গণমাধ্যম৷ অভিযোগ রয়েছে, সরকার বা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার চাপে পড়ে গুমের খবরগুলো এড়িয়ে যায় সংবাদমাধ্যমগুলো৷ তবে এটাও সত্য গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজন আর সরকারি ভাষ্যেই আটকে আছে সংবাদ মাধ্যমের খবর৷

কিন্তু গুম নিয়ে যেসব গবেষণাগুলো অন্তত দেশে হচ্ছে সেগুলোর তথ্যের উৎস্য আবার দেশেরই সংবাদ মাধ্যমগুলো৷ আইন ও শালিস কেন্দ্রের যে পরিসংখ্যানে এখানে তুলে ধরা হয়েছে, সেই তথ্যের উৎসও গণমাধ্যমই৷ যেখানে রয়েছে দৈনিক পত্রিকা থেকে অনলাইনভিত্তিক সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোও৷ সেখান থেকে বোঝা যায় গুমের খবরগুলো গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গেই উঠে আসে৷

সাধারণভাবে কোনো ব্যক্তি যখন নিখোঁজ হন, তখন তার পরিবার ও স্বজনদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রকাশিত হয়৷ সংবাদ পরিবেশনের সময় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের চেষ্টা করে গণমাধ্যম৷ যেমন: নিঁখোজ হওয়ার ঘটনাস্থল, ঘটনাস্থলে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলে তার ফুটেজ সংগ্রহ করা, প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান নেয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য নেয়ার মাধ্যমে সংবাদটি পরিবেশন করা হয়৷

গুমের ক্ষেত্রে ফলোআপও উঠে সংবাদ মাধ্যমে৷ সেক্ষেত্রে অবশ্য গুম হওয়া ব্যক্তির আত্মীয়, স্বজনরা যদি মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলনের মতো কোনো কর্মসূচি পালন করে সেই খবরটিও গুরুত্ব সহকারে ওঠে আসে পত্রিকার পাতায় কিংবা টেলিভিশন, অনলাইনে৷

নতুন সহস্রাব্দে এসে শিল্পপতি ও বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন নিখোঁজ হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় গুম৷ ২০০৩ সালের ২৪ জুলাই রাতের কথা৷ চট্টগ্রামের চকবাজারের অবস্থিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে চান্দগাঁওয়ের বাসায় ফেরার পথে অপহৃত হন শিল্পপতি ও বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন৷

তার পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে অপহরণের দুই বছর পর ফটিকছড়ির কাঞ্চননগরের পাহাড়ি এলাকা থেকে ২০০৫ সালের ২৪ আগস্ট জামাল উদ্দিনের কঙ্কাল উদ্ধার করে র‌্যাব৷ সিঙ্গাপুরে ডিএনএ পরীক্ষার পর কঙ্কালটি জামাল উদ্দিনের বলে নিশ্চিত হয় পরিবার৷ এরপর অপহরণ মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তর করে শুরু হয় তদন্ত৷

তবে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল গুম হয় বিএনপির আরেক নেতা ইলিয়াস আলী৷ এত বছর পেরিয়ে গেলেও তার পরিণতি এখনও জানা যায়নি৷

বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী এবং নারায়ণগঞ্জের শীর্ষ সন্ত্রাসী নুরুল আলম মাকসুদকে বহনকারী গাড়িকে আরেকটি গাড়ি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে অপহরণ করা হয়েছিল, ঠিক একইভাবে ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল অস্ত্রের মুখে দুর্বৃত্তরা অপহরণ করে গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আবুবকর সিদ্দিককে৷ যিনি ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পাওয়া বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী৷ ওই ঘটনা দেশ জুড়ে আলোড়ন তুলেছিল৷

ওই সময় বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমে সংবাদটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই উঠে এসেছিল৷ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে অপহরণের ৩৫ ঘণ্টা পর আবুবকর সিদ্দিককে ঢাকার মিরপুরে ছেড়ে দিলেও, অপহরণের কারণ জানা যায়নি৷

ফিরে আসার পর আবুবকর সিদ্দিক নারায়ণগঞ্জ আদালতে জবানবন্দিও দেন৷ তবে জবানবন্দিতে অপহরণের কারণ এবং অপহরণকারী সম্পর্কে তিনি কোনো তথ্য দেননি৷ অপহরণকরীদের বিষয়ে কিছুটা বর্ণনা দিলেও তাদের পরিচয় জানতেন না তিনি৷ এছাড়া পুরোটা সময় তাকে কোথায়, কিভাবে রাখা হয়েছিল, সে বিষয়েও বলতে পারেননি আবুবকর৷

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গুম হওয়া ব্যক্তিরা ফিরে এলে, তারা কোনো তথ্যই দিতে পারেন না কিংবা দিতে চান না৷ বেশিরভাগ সময় মুখই খুলতে চান না তারা৷ ফলে বিষয়গুলো রহস্য ঘেরাই থেকে যায়৷ তা নিয়ে গণমাধ্যমও তেমন কোনো সংবাদ প্রকাশ করতে পারে না৷

আবার গুম হওয়া ব্যক্তিরা ফিরে আসার পর গণমাধ্যমে পরিষ্কার করে কথা বলার ক্ষেত্রে অনীহা দেখায় স্বজনরা৷ বরং মানুষটিকে ফিরে পাওয়া নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন তারা৷ অথচ ফিরে পাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা থাকেন উচ্চকিত৷

রাজনীতিক থেকে ব্যবসায়ী কিংবা সংবাদকর্মী—সবার ক্ষেত্রেই একই ঘটনা৷ ফিরে আসার পর তারা এক ধরনের নিরবতা পালন করেন৷ সেই নীরবতার রহস্যটাও ভেদ করা যায়নি৷ সমাজের প্রচলিত ধারণা হলো চাপে পরে, ভয়ের কারণে, আবারও গুম হয়ে ফিরে না আসার আশঙ্কা থেকে নীরবতা পালন করেন সবাই৷

তবে এসব অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে তেমন কোনো ভূমিকা এখনও দেখা যায়নি৷ কারা গুম করে, কিভাবে গুম করে সেই বিষয়ে গুম হওয়া ব্যক্তি ও তার স্বজন এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে যা পাওয়া যায় শুধু সেটুকু প্রতিফলিত হয় সংবাদ মাধ্যমে৷ কিন্তু নিজেরা তদন্ত করে কিছু বের করে আনার প্রবণতা এখনও দেখা যায়নি৷ তার উত্তরে সংবাদকর্মীরা অবশ্য বলছেন, ঘটনা খুঁজতে গিয়ে কোনো কূল কিনারা পাওয়া যায়না৷ এজন্য ভিক্টিম ও স্বজনদের নিরবতাও সংবাদ মাধ্যমের চেষ্টাকে আটকে দিচ্ছে বলে বলা হয়৷

গত ২১ মার্চ বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ-সিজিএস-এর তত্ত্বাবধানে করা এক গবেষণায় ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ৭১ জনকে গুমের তথ্য উঠে এসেছে৷

এই সংগঠনটিও জানিয়েছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ঘেঁটে তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে৷ তারা জানিয়েছে ২০১৯ সালে ৩১টি, ২০২০ সালে ১৬টি এবং পরের বছর ২৪টি ‘গুমের' ঘটনা পেয়েছে তারা৷

এদিকে গুমের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে অভিযোগের তীর থাকলেও তা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে সরকার৷ এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী কোনো গুমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়৷ যেখানে গুম হচ্ছে, তাকে কিছুদিন পর পাচ্ছি৷ হয়তো নানা কারণে তারা আত্মগোপন করে থাকে, সেগুলোকে গুম বলে চালানো হয়৷ দু-একটি আত্মগোপন করার তথ্য আমরা পাইনি৷ আমরা মনে করি, এদের অচিরেই সামনে নিয়ে আসতে পারব৷’

তানজীর মেহেদী, সাংবাদিক
তানজীর মেহেদী, সাংবাদিকছবি: Privat

গুমের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন সরকারের কাছে গুম হওয়া যে ৭৬ ব্যক্তির তালিকা দিয়েছিল, তাদের বিষয়ে বাংলাদেশ সফরে আসা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাচেলেটকে অবগত করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল৷

গত রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেলের সঙ্গে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ বৈঠক শেষে আসাদুজ্জামান খান জানান, ‘৭৬ জনের মিসিং বা ডিসঅ্যাপিয়ার্ড পারসনের তালিকা দেয়া হয়েছিল, আমাদের বলা হয়েছিল৷ আমরা দেখিয়ে দিয়েছি এ ৭৬ জনের মধ্যে ১০ জন তাদের বাড়িতেই আছেন৷ দুজন আছেন জেলখানায়৷’

ঘৃণ্য অপরাধ যারা করে, পুলিশকে পিটিয়েও যারা হত্যা করে, তারা সীমান্তের ফাঁকফোকর দিয়ে বিভিন্ন দেশে চলে গেছে বলেও ব্যাশেলেটকে অবহিত করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ তার দাবি, তারা ভারত কিংবা মিয়ানমার কিংবা অন্য কোনো জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে৷

ফলে গুমের ক্ষেত্রে আসলে সরকারি ভাষ্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য এবং গুমের শিকার ব্যক্তির স্বজনদের ভাষ্যের ওপরই অনেকখানি নির্ভর করতে হয় গণমাধ্যমকে৷ সেক্ষেত্রে যারা গুম হয়ে ফিরে এসেছেন তারা যদি সাহস করে মুখ খুলতেন, তাহলে হয়তো আরও কিছু বিষয় উদ্ঘাটন সম্ভব হতো৷

এমনকি বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজও বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত যারা গুম হয়েছেন, তাদের ২৩ জন ফিরে এলেও তারা নিখোঁজ থাকা অবস্থায় কোথায় কেমন ছিলেন, তা নিয়ে কোনো কথা বলতে চাননি৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য