সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্পর্ক, গোপনীয়তা নিয়ে অসতর্ক আচরণ
৬ জানুয়ারি ২০২৩এর ফলে মি টু আন্দোলনের ভুক্তভোগীদের অভিযোগ কি হালকা হয়ে যাচ্ছে? কী বলছেন নারীবাদী, ভুক্তভোগী, আন্দোলনকর্মী এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা?
সম্প্রতি নুহাশ হুমায়ূনের সঙ্গে একটি ডেটিং অ্যাপ থেকে নেয়া কথোপকথনের ছবি (স্ক্রিন শট) প্রকাশ করেন এক নারী। তিনি কথোপকথনের ছবি নিয়ে নিজের ফেসবুক ওয়ালে তুলে অভিযোগ করেন, তাকে ওই ব্যক্তি শারীরীক সম্পর্কের প্রস্তাব দিয়েছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি এ দেশের একজন সুপরিচিত এবং একজন জনপ্রিয় সাহিত্যিক ও পরিচালকের সন্তান। স্বাভাবিকভাবেই ঘটনাটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। স্ক্রিন শটটিতে দেখা যায়, ওই নারীর সাথে অভিযুক্ত ব্যক্তির বেশ কিছু দিনের আলাপ চলেছে। কথোপকথনের এক পর্যায়ে কফি খাবার প্রস্তাব দেন পুরুষটি। ওই নারী কফি খাওয়ার প্রস্তাবকে শারীরীক সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা হিসেবেই ব্যক্ত করেছেন।
সামাজিক যোগামাধ্যমে স্ক্রিন শট প্রকাশের পর যা হয়েছে
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই স্ক্রিন শট ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে উভয়ের পক্ষে বিপক্ষে নানা মত দিচ্ছেন নেটিজেনরা। এর সঙ্গে যুক্ত নারী পুরুষ দুজনকেই নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতে হচ্ছে। কফি খাওয়া নিয়ে ট্রলও শুরু হয়ে গেছে বিভিন্ন মাধ্যমে। এ ধরণের খবরে প্রথমেই যা হয়, তা হলো দুজন ব্যক্তির চারিত্রিক দোষারোপ শুরু হয়, যেখানে টেনে আনা হয় পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও। আমাদের দেশে মাঝে মাঝেই জনপ্রিয় কিংবা সাধারণ অনেকের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমেও এ ধরনের কথোপোকথন স্ক্রিন শট, কখনও অডিও-ভিডিও আকারে ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ছে। এর মধ্যে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, প্রশাসন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এমনকি শিক্ষকও রয়েছেন। অভিযোগকারী এবং অভিযোগগুলোর চলমান প্রবণতা থেকে যৌন হয়রানি, ট্রল, নারী-পুরুষ সম্পর্ক, সামাজিক মর্যাদা, যৌনতা প্রকাশ, বিচার ব্যবস্থাসহ অনেক কিছু নিয়েই নতুন করে ভাবাচ্ছে সব শ্রেণি পেশার মানুষদের।
মি-টু আন্দোলনের ধারাবাহিকতাই কি এই এক্সপোজ প্রবণতা
বেশ কয়েক বছর আগে যখন মি-টু মুভমেন্ট শুরু হয়, তখন নারীরা, এমনকি পুরুষেরাও তাদের জীবনে অতীত কিংবা চলমান যৌন হয়রানি-নিপীড়নের তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করতে থাকেন। বিচার ব্যবস্থার বাইরে, নিপীড়কের পরিচয় তুলে ধরে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশের বিষয়টি বেশ সাড়া ফেলে সারা বিশ্বে। মূলতঃ সেলিব্রেটিদের এ আন্দোলনে ক্রমান্বয়ে যুক্ত হন সাধারণ নারীরাও। যার ছোয়াঁ এদেশেও এসে লাগে। তারই ধারাবাহিকতায় অনেক অজানা নিপীড়ক এবং নির্যাতিতের তথ্য পাওয়া যায়। তবে বেশ কয়েকটি কারণে এই মি-টু মুভমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তোলেন নেটিজেনরা। তার প্রধান কারণটি ছিল সোশাল মিডিয়ায় কাউকে ডিফেইম করার মধ্য দিয়ে বিচার আসলে কার কাছে চাওয়া হয়, এই চাওয়ার মধ্যে মনোতুষ্টি থাকলেও, দোষী ব্যক্তিরা বিচারের আড়ালেই রয়ে যাচ্ছিলেন। দ্বিতীয় বিতর্ক ছিলো মিথ্যে, বানোয়াট গল্প ফেঁদে কাউকে কাউকে বিতর্কিত এবং তার সম্মানহানি করা।
মি-টু আন্দোলনের এক অংশীজন আসমাউল হুসনা, তিনি বাংলাদেশ ইন্সস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে কমিউনিকেশন অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলছেন যে দেশে বিচার ব্যবস্থায় একজন নারীর সহজে এসব বিষয় নিয়ে বিচার পাবার উপায় নেই, সেদেশে মি-টুর মতো মুভমেন্টে মেয়েরা যে কথা বলছে, নিপীড়কদের নাম প্রকাশ করে তথ্য দিচ্ছে এটা স্বাগত জানানো উচিৎ। আর সম্প্রতি স্ক্রিন শট প্রকাশের ট্রেন্ড আর মিটু আন্দোলন কোনোভাবেই এক বিষয় নয়। কারণ মিটুর রাজনৈতিক ও নৈতিক প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। মিটুতে মেয়েরা নিজেদের না বলা কথাগুলো, যেগুলো তাকে মানসিক, শারীরিকভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে তা বলতে চেয়েছে। পরিবার, কর্মক্ষেত্র কিংবা রাস্তাঘাটে তাদের নিপীড়নের কথা বলতে চেয়েছে, যা তারা কোনোদিন বলতে পারবে বলে ভাবেনি। কিন্তু মিটু তাকে সেই প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে। এখানে ডিফেইমের প্রশ্নই আসে না।
সম্প্রতি যে নারী স্ক্রিন শট প্রকাশ করেছে সে যে নির্যাতিত তা কি বলেছে, না। আসমাউল জানান, ‘‘পশ্চিমা দেশগুলো মিটু আকারে উঠে আসা অনেকের এ ধরনের অভিযোগ বিচারালয়ে গিয়েছে, অনেকের সাজা হয়েছে। কিন্তু দেখেন আমাদের বিচার ব্যবস্থায় কিন্তু এই সুযোগ নেই। কারণ দীর্ঘ দিন আগে ঘটে যাওয়া কোনো যৌন হয়রানির ঘটনাকে সাক্ষী-প্রমাণ দিয়ে আদালতে উপস্থাপন করে বিচার পাবার কোনো আইনগত নজির এদেশে নেই। তিনি বলেন, সুযোগসন্ধানীরা সব ক্ষেত্রেই আছে। কেউ মিথ্যা তথ্য দিলে সেটির অবশ্যই বিচার হওয়া উচিৎ। আর বর্তমানে সাইবার ক্রাইম ইউনিট আছে আলাদা, কাউকে হয়রানি করা হলে সেখানে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ আছে।''
অভিনেত্রী বন্যা মির্জা বলছেন, "যখন কোনো অ্যাপ সুনির্দিষ্ট বিষয়কেই উপস্থাপিত করে, তখন সেখানে যারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন তখন নিশ্চই জেনেই করছেন। তবে জানার পরও কেউ যৌন হয়রানির শিকার হতে পারেন। সেক্ষেত্রে দেশের আইনেই এর প্রতিকার পাবার উপায় আছে।'' ডেটিং অ্যাপে কাউকে শারীরিক সম্পর্ক করার প্রস্তাবকেও আক্রমণাত্মক হিসেবে দেখছেন না তিনি। আরগোপনীয় বিষয় প্রকাশকে একটা আন্দোলন নামে চালাতে থাকা নিয়েও সতর্ক করেন তিনি৷ বলেন, ‘‘"ইনবক্স কনভারসেশনে কেউ যৌন হয়রানির শিকার হলেও সেটা এক্সপোজ হিসেবে আাসা উচিৎ কিনা বিষয়টা ঔচিত্যের চাইতেও প্রায়োগিকতা আর কমনসেন্সের। কেউ হয়রানির শিকার হবার পর যদি অনুভব করেন যে হয়রানিকারীকে এক্সপোজ করাতে তার কিছু যন্ত্রণা লাঘব হবে তাহলে তো আমরা কেউ সেখানে বলার কেউ না। আবার কমনসেন্সের কারণেই অনেক কিছুতে মানুষ আইনের কাছে যান না।’’
তিনি মনে করেন, ডেটিং এ্যাপে বিছানায় যাবার প্রস্তাবও আক্রমণাত্মক নয়। বলেন, ‘‘সাধারণভাবেই গোপনীয় জিনিস প্রকাশকে একটা আন্দোলন নামে চালাতে থাকা নিয়ে সতর্ক করব লোকজনকে আমি। একজন শারীরিক সম্পর্ক চাইবে কিন্তু কথা বলার সময় বলবে, এবারের শীত নিয়ে এসবই বরং অসুবিধার কথা। যতক্ষণ অন্য প্রান্তের মানুষ মানা করতে পারছেন এবং মানা করার কারণে হিংস্রতার মধ্যে পড়তে হচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব বা আধ্যাত্মিক সম্পর্কের প্রস্তাবকে আমি হয়রানি হিসাবে দেখি না।’’
এক্সপোজ প্রবণতার এ ধরনের প্রেক্ষাপটে, মি-টু আন্দোলন নিয়ে নতুন করে ভাবার দরকার আছে কিনা, এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন্যা বলেন, ‘‘আমি বেশ আগেই মি-টু নিয়ে কথা বলেছি। আবার আমার কথার খুবই উল্টোপাল্টা ব্যাখ্যা হয়েছে। এভাবে করে শেমিং রাজনীতিতে লম্বা সময়ের উপকারের সম্ভাবনা নাই। সেটা বোধহয় প্রমাণও হয়েছে মি-টু নিয়ে। তাছাড়া একেকটা দেশের আইনি কাঠামো, সহকর্মী পুরুষালি ব্যবস্থার ধরন, চাকরিক্ষেত্রে নিয়মকানুন আর নারীর ভোগান্তিগুলো সবই আলাদা। ফলে আন্দোলন তো কাস্টমাইজড হতেই হবে।"
বিজ্ঞাপন নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী এই ধরণের স্ক্রিন শট স্ক্যান্ড্যালের শিকার হয়েছিলেন বছর কয়েক আগে। তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে, এক নারীর সঙ্গে আপত্তিকর কথোপকথন চালিয়ে, সেটার স্ক্রিন শট নিয়ে ছড়িয়ে দেয়া হয় সামাজিক মাধ্যমে। এ নিয়ে বেশ ভুগতে হয়েছিলো তাকে। তিনি বলেন, কাউকে কফি খাওয়ার প্রস্তাব দেয়া দোষের কিছু নয়। এখানে তো কোনো ফৌজদারি অপরাধ হয়নি।
ফ্লার্টিং কি যৌন হয়রানি?
ফ্লার্টিং যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে কিনা জানতে কথা বলেছিলাম সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী মিতি সানজানার সঙ্গে। তিনি বলেন, কিছু কিছু হয়রানির মধ্যে ফ্লার্টিং যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে, তবে উভয়পক্ষের সম্মতিতে যখন কোনো কথোপকথন চলে তখন সেটা যৌন হয়রানির মধ্যে পড়বে না। স্ক্রিন শট প্রকাশ করার যে প্রবণতা সেটি বাংলাদেশের আইনে পরিষ্কারভাবে একটি অপরাধ। মিতি এই প্রবণতা থেকে সরে আসার কথা বলেন। তিনি বলেন, সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে যে আইনটি রয়েছে এর ২৯ ধারায় মানহানির বিচার করা হয়ে থাকে। কেউ কাউকে এ ধরনের মাধ্যমে কোনো তথ্য প্রকাশ করে অপমান, অপদস্ত বা সম্মানহানি করতে চায় তাহলে এটি অপরাধ।
তিনি আরও জানান, ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় যে সমস্ত বিষয় মানহানিকর, সেই তথ্য যদি প্রচার এবং প্রকাশ করে থাকেন, তিনি অনধিক তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ভোগ করবেন বা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হতে পারে। সেটা ছাড়া দণ্ডবিধি ৫০০ ও ৫০১ ধারায় মানহানির বিচার করা হয়। এতে দুই বছরের কারাদণ্ড সঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। এই আইনজীবী জানান, সম্প্রতি অনেকের মিথ্যা, বানোয়াট বিষয় প্রকাশের প্রবণতা, সত্যিকার অর্থে যারা নির্যাতিত তাদের অভিযোগগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তাই তিনি মনে করেন, নারী কিংবা পুরুষ যিনিই অভিযুক্ত হন না কেনো, ভুক্তভোগীর উচিৎ তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা।
মিটু নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে কিনা?
নারী অধিকার কর্মী নাদিয়া ইসলাম বলছেন, ‘‘যদি ফৌজদারি অপরাধ না হয়, নৈতিক অপরাধ না হয় তাহলে এক্সপোজ করার বিষয়টা কি? কফি খাওয়ার অফার খুব স্বাভাবিক প্রস্তাব। আর যদি যৌন সম্পর্কের কথা বলা হয়, অর্থাৎ কারো সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব কেউ দিয়ে থাকলে সেটা আসলে কোন প্রেক্ষাপটে দেয়া হয়েছে তার ওপর নির্ভর করবে, এই প্রস্তাবকে কীভাবে দেখা হবে।''
নাদিয়া বলেন, ‘‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে মিটু নিয়ে অবশ্যই এখন নতুন করে ভাবার দরকার আছে। প্রত্যেকটা আন্দোলনের সময়ের সঙ্গে, ব্যক্তির পারসপেকটিভ, ঘটনা প্রবাহ সবকিছুর টাইমলাইন চেক করা উচিৎ। কারণ মিটুর মূল বিষয়টাই ছিলো, আমি যে বিচার পাইনি, আমি সেটা যেনো পাই। এখন মিটু যদি অপব্যহার করে আর একটা এক্সপ্লয়টেশনের জায়গা হয় তাহলে সেটা অবশ্যই দুঃখজনক। বাংলাদেশে একটা জিনিসই খুব হয়, বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ। এই ঘটনাতেও তো অনেককে শুধু হয়রানি করার জন্যই মামলা দেয়া হচ্ছে। আর এগুলোর ভুক্তভোগী হচ্ছেন, যারা আসলেই নির্যাতিত হচ্ছেন মূলতঃ তারাই, তাদের বিচার চাইতে গিয়ে।''
নাদিয়া এ সময় গণমাধ্যমে এ ধরণের ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট করার ধরন নিয়েও আপত্তি করেছেন। এ ধরনের ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে যেভাবে প্রকাশ হয়, তার প্রভাব পড়ছে তরুণদের মধ্যেও। তারাও ওই ভাষাতেই ভুক্তভোগীদের ট্রল করছেন, বিচার করছেন। গণমাধ্যমও বিভিন্ন তথ্যের মাধ্যমে মোরাল পুলিশিং করছে। বিশেষ করে সেলিব্রেটিদের এসব বিষয় নিয়ে এক ধরনের চটকদার হেডলাইন করছেন, যা সাংবাদিকতার নৈতিক বিষয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যেমন একজন নায়িকার কয়টা বিয়ে, একজন নায়কের বাবার কি দোষ ছিলো, এগুলোতো আসলে মানুষের কালেকটিভ সাইকোলজিতে প্রভাব ফেলছে। একজন যখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পরনিন্দা তার কালচার, মানুষকে হেরাস করা তার কালচার তখন ব্যক্তি পর্র্যায়ে এই চর্চাগুলো বাড়ে। তাই তরুণদের দোষ দেয়ার আগে গেইট কিপারদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
সঞ্জয় দে, যিনি অনলাইনভিত্তিক পোর্টাল নিউজবাংলা টোয়েন্টি ফোরে বার্তা প্রধান হিসেবেও কাজ করছেন৷ তিনি বলছেন, ‘‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে আপনি আসলে বিচারালয় হিসেবে পরিণত করতে পারেন না। এটার অনেক বাজে দিক আছে, আমরা গণপিটুনিকে সমর্থন করি না, আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করতে পারি না। কারণ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়, সেই অভিযোগ প্রমাণ করতে গিয়ে কতগুলো ধারাবাহিক কাজের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, সাক্ষ্য প্রমাণের বিষয় আছে , চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স আছে যা বন্দুকযুদ্ধ বা গণপিটুনিতে থাকেম না। এক্ষেত্রে যেটা হয়, অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তিও ভুক্তভোগী হয়, আবার আসল অপরাধীও চলে যায় ধরা ছোয়াঁর বাইরে। একইভাবে স্যোশাল মিডিয়ায় কারো বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মতো অভিযোগ আনলে অভিযুক্ত ব্যক্তির আসলে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকে না। যদি সেটা থাকেও, যদি এই অভিযোগটি মিথ্যাও হয়, সেটি প্রমাণ করতে করতে তার সামাজিক মর্যাদা, ভাবমূর্তি, গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়। এমনকি যে নারী বা পুরুষ অভিযোগ করেন, উভয়কেই কিন্তু একই ধরনের হয়রানি হতে হয়। তাদের চরিত্র নিয়ে, তাদের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে চর্চা শুরু হয়।'' সঞ্জয় বলছেন, বাংলাদেশের আইনে এখন ইনবক্সে লঘু বা গুরু অবরাধের সুরাহা আছে। তাই ফেসবুকে বিচারের জন্য ছেড়ে দিলে সেটাও অপরাধের মধ্যে পড়ে এবং নৈতিকভাবেও এ কাজ করা যায় না।
তরুণরা কি ভাবছেন?
কাবেরী আযাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ড্রয়িং বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তার ভাবনা জানতে চেয়েছিলাম। কাবেরীর বললেন,‘‘আমার কারো কথা পছন্দ না হলে, কারো আচরণ হয়রানিমূলক মনে হলে আমার অনেক ধরণের বিকল্প পথ আছে তাকে বাধা দেয়ার। আমি তাকে রেস্ট্রিকটেড করতে পারি এবং ফেসবুক অথরিটিকে তার নামে অভিযোগ করতে পারি। কারো ফ্লার্টিং ভালো না লাগলে, তাকে তা সরাসরি বলতে শিখতে হবে। যৌন প্রস্তাবে হ্যাঁ বা না বলার স্বাধীনতা যে মেয়েদেরও আছে, মেয়ে হিসেবে সেটা বুঝাটা খুবই জরুরি।''
এক্সপোজ নিয়ে সাইবার ক্রাইম বিভাগ কী বলে
ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের সাইবার বিভাগ সিটি সাইবারের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘‘কিছু কিছু তথ্য প্রকাশ অবশ্যই সাইবার ক্রাইমের মধ্যে পড়ে। খুবই ব্যক্তিগত তথ্য, ফিনান্সিয়াল তথ্য, যৌনআবেদন আছে এমন বার্তা, ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং কথার ধরণে এসব ইঙ্গিত রয়েছে এমন স্ক্রিন শট সাইবার ক্রাইমের মধ্যে পড়তে পারে।'' তবে যেকোনো হয়রানি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশকে নিরুৎসাহিত করেন তিনি।
চলমান এক্সপোজ প্রবণতা নিয়েও উদ্বিগ্ন তারা। তাদের টিম কাজও করছে এ নিয়ে। যেকোনো ঘটনায় স্বঃপ্রণোদিত হয়ে এবং অভিযোগের ভিত্তিতে, দুইভাবেই কাজ করেন তারা। প্রয়োজন অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়। সাইবার ক্রাইম নিয়ে সচেতনা বাড়াতে তাদের বিভিন্ন কর্মসূচীও আছে। নাজমুল জানান, ‘‘যেসব মামলা তারা পান তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের অন্যতম কারণ হলো প্রতিশোধ পরায়ণতা। অনেক সময় কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য এভাবে এক্সপোজ করা হয়ে থাকে। আবার অর্থনৈতিক সুবিধা নিতে এমন তথ্য দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হয়। সামাজিকভাবে হেয় করতেও এক্সপোজ করেন অনেকে।''
এই কর্মকর্তা জানান, ‘‘সাইবার অপরাধে যেসব অভিযোগ আসে, তার আশিভাগ করেন নারী। যার মধ্যে ৭০ ভাগ বয়সন্ধিতে আছেন এমন কিশোরীদের অভিযোগ। তাদের অভিযোগগুলো বেশিরভাগ অ্যাকাউন্ট কম্প্রোমাইজ, পর্ণগ্রাফি, বুলিং এবং অর্থনৈতিক প্রস্তাবের।'' নাজমুল জানান, ‘‘সাইবার ক্রাইম ঠেকাতে দরকার সচেতনতা। রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি সবাইকে কাজ করতে হবে। সাইবার এথিক্স তৈরি করতে হবে। কোনটা করা যাবে, কোনটা যাবে না বুঝতে হবে। আইন আছে, তা মানতে হবে । সর্বোপরি নিজেকে অপরকে নিরাপদ করেই সাইবার জগতে কাজ করতে হবে।''