ইউক্রেনের ইউরোপ ভাবনা
৭ মে ২০১৩ইউক্রেনের স্বনামধন্য লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট সেরহি জাদান৷ কমিউনিস্ট শাসনামলের পর ইউক্রেনের সামাজিক পরিবর্তনের নানা দিক উঠে এসেছে তাঁর কবিতা ও উপন্যাসে৷ ২০০৬ সালে তিনি হুবার্ট বুর্ডা পদক লাভ করে৷ ইউরোপের সঙ্গে ইউক্রেনের টানাপোড়েনের কথা তুলে ধরেছেন তিনি এভাবে:
তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক বিশ্বের' কোনো ধারণাই নেই যে, যে ইউক্রেনের মতো দেশের মানুষদের তারা কতটুকু আশা জাগাতে পারেন৷ ইউক্রেনের মানুষরা যে তাঁদের ওপর আস্থা রাখে, তাঁদের কথা ভাবে এবং তাঁদের ব্যাপারে বেশ হতাশা বোধ করে এ সম্পর্কে তারা হয়তো জানেনও না ৷ ইউরোপীয়দের কাছে এটা সুদূরের কোনো ঘটনা, যেখানে আধুনিক ট্রেনলাইনগুলি হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে এবং রাস্তাঘাটের অবস্থাও প্রচণ্ড খারাপ৷
শেঙেন অঞ্চলে শান্তিতে বসবাসরত বার্লিন, ভিয়েনা কিংবা জুরিখের বাসিন্দারা কেমন করেই বা ইউক্রেনের ৪০ মিলিয়ন মানুষের কথা অনুভব করতে পারবেন, যারা একটি সুন্দর ভবিষ্যতের আশা করে৷
ইউরোপ আমাদের কাছে যেন পৃথিবীর স্বর্গ
ইউরোপ শব্দটি ইউক্রেনবাসীর কাছে বিশেষ অর্থ বহন করে৷ ইউক্রেনের মানুষ ইউরোপের ব্যাপারে নানা রকম ধারণা পোষণ করেন৷ ইউরোপ অর্থ ভালো মানের গাড়ি (মাঝেমাঝে অবশ্য সেগুলো চীনেও উৎপাদিত হতে পারে)৷ ইউরোপ অর্থ পুষ্টিকর খাদ্যসামগ্রী (সেগুলো অবশ্য ইউক্রেনিয়ান-পোলিশ সীমান্তের কাছেও উৎপন্ন হতে পারে) ইউরোপ অর্থ বেশী বেতন, আইনি রাষ্ট্র, সহনশীলতা ও মাল্টিকালচারালিজম, স্বাধীনতা, উদারনীতি এবং পুরোনো কমিউনিস্ট শাসনামলের বিরুদ্ধে লড়াই৷
ইউক্রেনের অনেকে মনে করেন, যে সীমান্তের অপর পাশে হাঙ্গেরিতে হাওয়া ছিল ভিন্ন রকম এবং খুব সহজ পথে সমস্যার সমাধান হয়েছিল – এমনকি বলতে গেলে কোন সমস্যাই তৈরি হয়নি৷ স্বাধীনচেতা ইউক্রেনিয়ানদের কাছে ইউরোপ একটি ‘প্রতিশ্রুত ভূমি'৷ তাঁরা নিজেদের এই ভ্রাতৃসমাজের বড় পরিবারের সদস্য হিসেবে মনে করেন, যাদের সাথে তাদের মূল্যবোধ ও মানসিকতার মিল রয়েছে এবং যার জন্য তাঁরা অধৈর্য হয়ে প্রতীক্ষা করছে৷ তবে ইউক্রেনিয়ানদের অপর অংশ সাবেক সোভিয়েত আমলটাকেই যেন ফিরে পেতে চান৷ তাঁদের কাছে ইউরোপ মন্দ ও নষ্ট সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু৷
যাহোক, ইউক্রেনে ইউরোপের উপস্থিতি যতটা ধারণা করা হয়েছিল তার চেয়ে বেশী শক্তিশালী – এমনকি রাজনৈতিক অঙ্গনেও৷ ভিন্নভাবে হলেও সকল রাজনীতিবিদ ইউরোপের কথা বলেন৷ ক্ষমতাসীনদের এ ব্যাপারে কিছুটা উদ্বেগ রয়েছে৷ সেটা তাঁরা প্রকাশও করেন৷ বিরোধীরাও ইউরোপের কাছে বড় রকমের প্রত্যাশা করেন৷
ইউরোপ যেন 'জন্মদিনের কেক'
ইউক্রেনের রাজনীতিকরা ইউরোপ সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলেন, যেমনটি করে শিশুরা জন্মদিনের কেক নিয়ে৷ অবস্থা এমন যে তারা অনেকক্ষণ ধরে রান্নাঘরে অপেক্ষা করে একটি মাত্র সমস্যার সমাধান বের করতে, যে কেকটি তখনি খাবে নাকি আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? আমরা বিভ্রান্তির মধ্যে এবং বিদেশিদের মনোযোগ আকর্ষণের অলীক আশা নিয়ে বসে আছি৷ আমরা বিদেশি নেতাদের বিবৃতির দিকে তাকিয়ে থাকি, এই আশায় যে, অর্থনৈতিক স্বার্থের পেছনে হয়তো অপেক্ষা করছে বৈশ্বিক গণতন্ত্রের উজ্জ্বল রশ্মি৷
আমাদের অবশ্যই নিজেদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে!
ইউক্রেনের জনসাধারণ মনে করে, ইউরোপ তাদের দুর্নীতিবাজ প্রশাসনের সঙ্গে একত্রে কাজকর্ম করছে৷ যদিও তারা নিজেরাই এই সরকারকে নির্বাচিত করেছে৷ ইউক্রেনীয়রা অনেক ক্ষেত্রেই ইউরোপকে দায়ী করতে চায়৷ ইউরোপ তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সমাধান করেনি, জনগণের পক্ষ নেয়নি, কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেনি, কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি৷ এসব ‘দোষ' তারা ইউরোপের ঘাড়েই চাপাতে চায়৷ এছাড়া স্থায়ী শেঙেন ভিসা না দিয়েও ‘অপরাধ' করেছে ইউরোপ৷ যার মাধ্যমে সব সমস্যা ও সংঘাত পেছনে রেখে দেশ ছেড়ে একেবারে চলে যেতে পারতো তারা৷
আমার দৃষ্টিতে ইউক্রেনের বর্তমান সমাজের প্রধান সমস্যা হল তাঁদের অযোগ্যতা ও ইচ্ছার অভাব৷ নিজের কাজের দায়দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা৷ আমরা নিজেদের ভুল ও বোকামির দায়দায়িত্ব নিজেরা নিতে চাই না৷ আমরা সহজেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাই৷
তবুও বলতে হয়, ইউরোপ ছাড়া আর কার ওপরই বা আমরা ভরসা করতে পারি? যদিও এই ভূমিকা সম্পর্কে ইউরোপের নিজেরই কোনো ধারণা নেই৷