ফেসবুক কি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত? এই প্রশ্ন বিশ্বের নানা প্রান্তে নানা সময়ে উঠেছে৷ এক্ষেত্রে দু'টি বিষয়ের দিকে গুরুত্ব দেয়া উচিত৷ প্রথমত, বাকস্বাধীনতা৷ দ্বিতীয়ত, ভুয়া খবর আর গুজব রোধে ফেসবুক নিয়ন্ত্রণ৷
বাকস্বাধীনতার প্রশ্নে সচেতন এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি আছে, এমন কেউই ফেসবুকের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের পক্ষে কথা বলবেন না৷ কারণ, বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই সামাজিক যোগাযোগ সাইটটি মানুষের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিতে এক বড় ভূমিকা রাখছে৷ এখন যেকেউ একটি ফেসবুক একাউন্ট ব্যবহার করে তার মতামত গোটা বিশ্বকে জানিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে পারে৷ ফলে, সাধারণ-অসাধারণ সব মানুষের বাকস্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিতে এক শক্তিশালী হাতিয়ার ফেসবুক৷
কিন্তু ফেসবুকের এই ব্যবহার জনগণের উপর অযোচিত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, স্বৈরতন্ত্র বা স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ করে - এমন সরকারগুলোর পছন্দ নয়৷ ফলে তারা নানাভাবে সরকার সমালোচক, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট, ব্লগার, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাসহ অনেকের বাকস্বাধীনতা হরণ করতে তাদের ফেসবুক একাউন্টটি বন্ধ করে দিতে তৎপরতা দেখায়৷
হতাশার কথা হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে এই চর্চা বাংলাদেশেও দেখা গেছে৷ সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা এক্ষেত্রে এক বড় উদাহরণ৷ বাংলাদেশে ‘সরকার সমালোচক' হিসেবে পরিচিত যে কয়েকজন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ফেসবুকে সরব, তাদের একজন তিনি৷ ফেসবুকে তাঁর একাউন্টটি অনুসরণ করতো বেশ কয়েক হাজার মানুষ৷ তিনি গতবছর প্রথমে কয়েক মাসের জন্য তাঁর একাউন্টটি হারান৷ সেসময় একদল হ্যাকার স্বল্প সময়ের জন্য তাঁর একাউন্টটির দখল নিতে ও সেখান থেকে পোস্ট করতেও সক্ষম হয়৷
সে যাত্রায় গোলাম মোর্তোজার একাউন্টটি উদ্ধার সম্ভব হলেও এবছর সেটি পুরোপুরি হারিয়েছেন তিনি৷ অবস্থা এমন যে তাঁর নামে তৈরি করা একটি পাতায় বাংলাদেশ থেকে কাউকে মডারেটরও করা যায় না৷ কেননা কাউকে মডারেটর নিয়োগ করা হলে তাঁর একাউন্ট দ্রুতই নিষিদ্ধ করে দেয় ফেসবুক৷
এটা সত্য যে, কোন দেশের সরকারের পক্ষেই ফেসবুককে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়৷ আবার, একটি ফেসবুক পাতার এডমিন বা মডারেটর কে কে সেটাও সেই ব্যক্তিরা না জানালে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ছাড়া আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়৷ তাহলে, গোলাম মোর্তোজার ফেসবুক পাতার মডারেটর কারা, সেই তথ্য প্রকাশ হচ্ছে কিভাবে? সেই একাউন্টগুলো ফেসবুকে দ্রুত নিষিদ্ধই বা কেন হচ্ছে?
এসব প্রশ্নের উত্তরে নানা কথাই বলা যায়৷ ধারনা করা যায়, নির্দিষ্ট কোন চক্র গোপনীয় এই তথ্য কোনভাবে জানতে পারছে৷ এটা কি ফেসবুকের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোন দুর্বলতা, নাকি অন্যকিছু?
সাংবাদিক হিসেবে জল্পনাকল্পনা করা আমার কাজ নয়৷ ভবিষ্যতে এই বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করার ইচ্ছা আছে আমার৷ আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশে গোলাম মোর্তোজাই একমাত্র ব্যক্তি নন যার সঙ্গে এমনটা ঘটছে৷ বরং তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে৷ ফলে বিষয়টির সুরাহা হওয়া জরুরী৷
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে ফেসবুকের মাধ্যমে ভুয়া খবর কিংবা গুজব ছড়ানো৷ বাংলাদেশে গত কয়েকবছরে বেশ কিছু সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যার মূল কারণ ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়ানো ভুয়া খবর বা গুজব৷ এধরনের সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে তাই কার্যকর পদক্ষেপ জরুরী৷
এক্ষেত্রে জার্মানির উদাহরণ টানতে পারি৷ জার্মান সরকার ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে যাতে ভুয়া খবর বা গুজব ছড়িয়ে না পরে সেটা রোধে সম্প্রতি এক আইন করেছে৷ এই আইনে এধরনের পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট সামাজিক যোগাযোগ সাইটকে জবাবদিহিতার মধ্যে ফেলার এবং বেশ বড় অংকের জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে৷ ফলে সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলো জার্মান আইন মেনে কন্টেন্ট মডারেশনের জন্য বাড়তি লোকবল নিয়োগ করছে এবং নিরাপত্তা বিষয়ক তৃতীয় কোন প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করছে৷
আমার মনে হয়, বাংলাদেশ সরকারও ব্যবহারকারীর পাশাপাশি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকেও দায়বদ্ধ করার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে৷ তখন দেখা যাবে ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের জন্য কন্টেন্ট মডারেশনে প্রয়োজনীয় লোকবল এবং অন্যান্য আনুষাঙ্গিক বিষয়াদি বাড়াবে৷ অর্থাৎ বাংলাদেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে প্রতিষ্ঠানটির তরফ থেকেই উদ্যোগ নেয়া হবে৷ কারণ, দিনের শেষে ফেসবুক একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান৷
এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়৷ গত একযুগ ফেসবুক ব্যবহারের সময় দেখেছি, অনেক ব্যবহারকারীর মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি সম্পর্কে সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে৷ একটি পাবলিক ফেসবুক পোস্ট যে জগতের যে কারো পক্ষে দেখা সম্ভব সেই বোধটুকুও অনেকের মধ্যে নেই৷ এটা বিপজ্জনক৷ আমার মনে হয়, ফেসবুক কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, কী করা যাবে আর কী যাবে না - সেসব বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি জরুরী৷ আর তাতে সামাজিক যোগাযোগ সাইটটি আরো নিরাপদ হয়ে উঠবে৷
প্রযুক্তি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে ফেসবুক এবং ফেসবুকের মতো আরো অনেক নেটওয়ার্ক সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই থাকবে৷ তবে, সেগুলো ব্যবহারের আগে নিজেকে উপযোগী করে তুলবে হবে৷ এর কোন বিকল্প নেই৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷