1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সরকারি জমি দখল, মমতার হুমকি, দোকান ভাঙার প্রস্তুতি

২৫ জুন ২০২৪

সরকারি জমি দখল হওয়া নিয়ে দলের নেতা ও প্রশাসনকে দায়ী করছেন মুখ্যমন্ত্রী। নেতা-মন্ত্রী থেকে আমলা, সকলের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। মঙ্গলবার থেকে জবরদখল করা জমি উদ্ধারের চেষ্টা শুরু।

https://p.dw.com/p/4hTGm
কলকাতার হাতিবাগানে পুলিশ দোকানদের ফুটপাথ দোকান বন্ধ করার নির্দেশ দিচ্ছে।
উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে মঙ্গলবার থেকে সক্রিয় পুলিশ। ছবি: Satyajit Shaw/DW

সরকারি জমি বেদখল হয়ে যাওয়া নিয়ে দলীয় নেতৃত্ব ও প্রশাসনকে দায়ী করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভিন্ন পুরসভা, মন্ত্রী থেকে আমলা, সকলের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তারপর মঙ্গলবার থেকে জবরদখল করা জমি উদ্ধারের চেষ্টা  শুরু হয়েছে।

মঙ্গলবার কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় জবরদখল করা জায়গায় দোকান ভাঙার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। সল্ট লেকের সেক্টর পাঁচে জবরদখল করা দোকানে গিয়ে পুলিশ বলেছে, একদিনের মধ্যে সব জিনিস সরিয়ে নিতে হবে।

এসেসকেএম হাসপাতালের কাছে ফুটপাথ দখল করে থাকা দোকানদারদের সরে যেতে বলা হয়েছে। গড়িয়াহাটে ফুটপাথ দখল করে থাকা দোকানদারদেরও বলা হয়েছে, একদিনের মধ্যে জিনিস সরিয়ে নিতে। উত্তর কলকাতার হাতিবাগানেও পুলিশ দোকানদারদের ঝাঁপ বন্থ করে দিয়ে বলছে, একদিনের মধ্যে সরে যেতে। নিউ মার্কেটেও জবরদখল করে থাকা দোকান বন্ধ করে মালপত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে বলেছে পুলিশ। 

সরকারি জমি, ফুটপাত বা জলাশয় দখল হয়ে যাওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। বারবার অভিযোগ উঠেছে, শাসক দল ও পুলিশের মদতে জমি দখলের কাজ চলে অবাধে। এর পিছনে থাকে প্রচুর টাকার লেনদেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অতীতে একাধিকবার এ নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আরো একবার তার মুখে কঠোর বার্তা শোনা গেলো। এমনকি আর্থিক লেনদেনের কথাও বলেছেন তিনি।

হাতিবাগানে ফুটপাথে জবরদখল দোকানের মালিক তার জিনিস গুছিয়ে রাখছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পর কলকাতার রাস্তা দখলমুক্ত করতে উদ্যোগী হয়েছে পুলিশ। ছবি: Satyajit Shaw/DW

নেতা আধিকারিকদের তোপ

সোমবার নবান্ন সভাঘরে আয়োজিত বৈঠকে মন্ত্রী, পুরসভার প্রতিনিধি, পুলিশ ও প্রশাসনের আধিকারিকরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সরকারি জমি বেদখল হওয়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তার মন্ত্রী, আমলা পুলিশও পুরনিগমের মাথাদের তীব্র সমালোচনা

রাজ্যের দুই মন্ত্রী সুজিত বসু ও অরূপ রায়ের নাম করে মমতা বলেছেন সরকারি জমিতে লোক বসিয়ে দেয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর বলেছিলেন, ''সুজিত সল্ট লেকে লোক বসাচ্ছে। সল্ট লেকের দিকে তাকানো য়ায় না।'' মন্ত্রী অরূপ রায়,  ফিরহাদ হাকিম থেকে ইন্দ্রনীল সেন, অনেকেই মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্নের মুখে পড়েছেন। তিনি ক্ষোভ জানিয়েছেন পুর পরিষেবা নিয়েও।

পুরসভাগুলির সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "একতরফা জমি দখল করবে। কোনো কাজ করবে না। এটা হতে দেওয়া যাবে না। কলকাতা, হাওড়া, সল্টলেক, নিউটাউন, শিলিগুড়ি এলাকায় কী হয়েছে, তা নিয়ে তদন্ত হবে।"

উত্তরবঙ্গের নেতা গৌতম দেব মুখ্যমন্ত্রীর নিশানায় ছিলেন। মমতা বলেন, "ডাবগ্রাম ফুলবাড়ি এলাকায় জমি মাফিয়াদের বাহিনী তৈরি হয়েছে। ভূমি দপ্তরের আধিকারিক ও পুলিশের একটা অংশ এর সঙ্গে যুক্ত। তদন্ত করে দেখতে হবে।"

সরকারি জমির পাশাপাশি জলাশয় বুজিয়ে বেআইনি বহুতল করার অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে বারবার উঠেছে। মমতা বলেন, "বেআইনি বাড়ির দু-একটা ভাঙুন। দু-একটা গ্রেপ্তার করুন।"

পুলিশ দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছে।
উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে মঙ্গলবার দোকান বন্ধ করার নির্দেশ দিচ্ছে পুলিশ। ছবি: Satyajit Shaw/DW

এ ধরনের বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা পুলিশের। তাদের দিকে আঙুল তুলে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, "যে অনিয়ম করেছে, তাকে গ্রেপ্তার করবে। আমি কাউকে ক্ষমা করব না। সব জমি দখলমুক্ত করব।" প্রোমোটার, ঠিকাদার, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ একই চক্রে অন্তর্ভুক্ত হয়ে জমি হাতাচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। মমতা কার্যত তাতে সিলমোহর দিয়ে বলেন, "অনেক ভদ্রতা দেখিয়েছি। কিন্তু ভদ্রতা দেখানোর মানে একতরফা জমি দখল নয়।"

মমতা বলেছেন, ''একদিনে সব হবে না। আমি ১৫ দিন দেখব।'' তার নির্দেশ কার্যকর হচ্ছে কিনা, তা দেখার দায়িত্ব তিনি মুখ্যসচিবকে দিয়েছেন।

দায়িত্বে রদবদল

নিজের সরকারের ভূমি দপ্তরের কাজে এর আগেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিশেষত সরকারি জমি বেহাত হওয়ার প্রশ্নে তিনি আগে থেকেই রুষ্ট ছিলেন। এবার দপ্তরের সচিব পদে রদবদল করলেন তিনি।

লোকসভা নির্বাচনের সময় নির্বাচনের কাজে বদলি করা হয়েছিল ভূমি দপ্তরের সচিবকে এস মহাপাত্রকে। তাকে আর পুরনো পদে ফেরানো হয়নি। ভূমি দপ্তরের সচিব করা হয়েছে বিবেক কুমারকে। এর জেরে একাধিক দপ্তরের সচিব পদে রদবদল হয়েছে।

বৈঠকেই নতুন সচিব বিবেক কুমারের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "তোমাকে ভূমি দপ্তরের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। এক শতাংশ ভাল পাবে। বাকিরা সব শেষ করে দিচ্ছে। জমির তালিকা পুরো চেয়ে নিয়ে অফিসারদের রদবদল করতে হবে। তোমাকে ক্লিন করার দায়িত্ব দেয়া হলো। কারো কথা শুনবে না।"

তোলাবাজির বিরুদ্ধে

বিরোধীরা বারবার অভিযোগ করেন, তৃণমূল জমানায় সাধারণ মানুষ থেকে ব্যবসায়ী, সবাইকে বিভিন্ন কাজের জন্য শাসক দলের নেতাদের টাকা দিতে হয়। এই তোলাবাজি নিয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারাও তৃণমূলের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার করেছিলেন গত লোকসভা নির্বাচনে।

এসব অভিযোগকে অনেকটা মান্যতা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সরব হয়েছেন টাকা তোলার বিরুদ্ধে। তার কথাতেই স্পষ্ট, সরকারি জমি বেদখল হওয়ার পিছনে টাকার খেলা রয়েছে।

বৈঠকে মমতা বলেন, "আমি টাকা তোলার মাস্টার চাই না, জনসেবক চাই। টাকার বিনিময়ে বাংলার আইডেন্টিটি বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে।" শুধু নিজের দলের নেতা নয়, পুলিশ-প্রশাসনের দিকে আঙুল তুলেছেন মমতা। বলেন, "আইসি, এসডিও, ডিএম-দের অনেকে মনে করছেন, সঞ্চয় করে নেব। বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। এগুলো আর করবেন না।"

জেলায় জেলায় নির্দেশিকা

মুখ্যমন্ত্রী কড়া অবস্থান নেয়ার পরই তৎপরতা বেড়েছে নবান্নে। সূত্রের খবর, কয়েক দফা নির্দেশিকা পাঠানো হচ্ছে জেলায় জেলায়।

নবান্নের বৈঠকে মমতা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, জমি দালালদের সঙ্গে প্রশাসনের একাংশের যোগ রয়েছে। নির্দেশিকার বলা হয়েছে, ভূমি দপ্তরের অফিসের আশপাশে দালাল চক্রের ঘোরাফেরা বন্ধ করতে হবে। সরকারি জমিতে সাইনবোর্ড লাগিয়ে লিখতে হবে, 'এই জমির মালিক রাজ্য সরকার'। সরকারি জমি কিছু দিনের ব্যবধানে নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে আধিকারিকদের।

সূত্রের খবর, জমি বা জলাশয়ের কোনো অংশ দখল হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে পরিদর্শনের পাশাপাশি ছবি তুলতে হবে ভূমি দপ্তরকে। সংশ্লিষ্ট জেলাশাসক ও অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি) পদে যারা রয়েছেন, তাদের কাছে এই নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে।

বিরোধীদের কটাক্ষ

তৃণমূল সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে ১৩ বছর আগে। তার আগে ২০১০ সাল থেকে তারা বিভিন্ন পুরসভা দখল করতে শুরু করে। পশ্চিমবঙ্গের পুর প্রশাসনে ঘাসফুল শিবিরের দাপট প্রশ্নাতীত। একই দলের পুর ও রাজ্য প্রশাসনের অধীনে যে ব্যাপক অনিয়ম চলছে, তা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

সরকারি জমি দখল, বেআইনি নির্মাণ, পুকুর ভরাট সংক্রান্ত অভিযোগ নতুন নয়। এর আগেও মুখ্যমন্ত্রী এসবের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে কিছুই পাল্টায়নি। তাই তাকে আবারও একই কথা বলতে হচ্ছে বলে মত বিরোধীদের। তাদের প্রশ্ন, আদৌ কি মুখ্যমন্ত্রী সমস্যার সমাধান করতে চান, নাকি এটা আইওয়াশ?

বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, না দুর্বল চিত্রনাট্য সাজাচ্ছেন, সেটা মানুষ জানে। যারা জনসেবা করবেন, তারা তৃণমূলে যাবেন না। তৃণমূলে থাকবে আর তোলা তুলবে না, এটা হয় নাকি!"

পুরসভাগুলির সঙ্গে বৈঠকে বাম ও কংগ্রেস পরিচালিত দুটি পুরসভার প্রতিনিধিদের ডাকা হয়নি বলে ক্ষোভ জানিয়েছে বিরোধীরা। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, "চোর তকমা দিতে পারবেন না বলে মুখ্যমন্ত্রী দুটো পুরসভাকে ডাকেননি। যাদের তিনি চোর বললেন, তারা পাল্টা বলতেই পারতেন, তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আর চোর বটে!"

মুখ্যমন্ত্রী ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখতে চাইছেন: বিকাশরঞ্জন

ভোট না তহবিল?

সম্প্রতি শেষ হওয়া লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিপুল জয় পেয়েছে তৃণমূল। ২৯টি আসনে জিতেছে তারা। কিন্তু শহুরে ভোটারদের একটা বড় অংশ তৃণমূলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। রাজ্যে যে ১২৬টি পুরসভা ও পুরনিগম রয়েছে, তার অধিকাংশে সমর্থন হারিয়েছে রাজ্যের শাসক দল।

পুরসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের আগে ফলের এই প্রবণতা তৃণমূলের কাছে অশনি সংকেত। পর্যবেক্ষকদের মতে, জমি দখল, জলাশয় বোজানো কিংবা তোলাবাজির জন্য শহর ও শহরতলির ভোটারদের একটা অংশ যে ক্ষুব্ধ, তা তৃণমূল নেত্রী বুঝতে পেরেছেন। সে কারণেই তিনি দলীয় নেতৃত্ব থেকে প্রশাসনের আধিকারিকদের নিশানা করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, গত এক দশকে যে রোগ চিহ্নিত হলেও সারানো যায়নি, আর এক দফা হুঁশিয়ারিতে কি তা নির্মূল হয়ে যাবে?

কলকাতার সাবেক মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে নির্বাচনকে জুড়তে রাজি নন। তিনি বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী বিভিন্ন ভাতা বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু রাজ্যে আর্থিক উৎস সংকুচিত হয়েছে। ফলে সরকারি সম্পত্তি বিক্রি করা ছাড়া উপায় নেই। সেটা করতে গিয়ে তিনি দেখছেন, সব দখল হয়ে গিয়েছে। দখল করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। তাই এখন মুখ্যমন্ত্রী আবেগপ্রবণ কথা বলে ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখতে চাইছেন।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷