সবচেয়ে দূষিত নদী সাফাইয়ের কাজে জার্মান কোম্পানি
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০সবচেয়ে দূষিত নদীর তকমা
বান্ডুং শহরের দক্ষিণে ২৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ চিতারুম নদীর উৎস৷ জাভার অন্যতম বড় নদী এটি৷ গত শতাব্দীর আশির দশকেও এলাকাটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল৷ ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংগঠন এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে নোংরা নদীর তকমা দিয়েছে৷ সাধারণ বর্জ্য পানি ও পোশাক কারখানার বিষাক্ত রাসায়নিকের পাশাপাশি বিশেষ করে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের মতো আবর্জনাও এই অবস্থার জন্য দায়ী৷
২০১৮ সালের শুরু থেকে সরকার এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ চিতারুম হারুম প্রকল্পের আওতায় ২০২৫ সালের মধ্যে এই নদীর পানিকে পানযোগ্য করে তোলার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে৷ ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনী এই প্রকল্পের মূল হোতা৷
প্লাস্টিক দূর করার পথ
চিতারুম নদীর ছয় নম্বর সেক্টরে মোরিৎস শুলৎস ও কার্স্টেন হিয়র্শের দেখা পাওয়া গেল৷ জার্মানির এই দুই ব্যক্তি ‘প্লাস্টিক ফিশার' নামের স্টার্টআপ কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা৷ কর্নেল ডোডোর সঙ্গে তাঁরা নিজেদের তৈরি ‘ট্র্যাশ বুম' নামের আবর্জনা ছাঁকার প্লান্টের প্রোটোটাইপ পরিদর্শন করছেন৷ হিয়র্শ বলেন, ‘‘চিতারুম হারুম প্রকল্পের কারণেই এই সব সেক্টর সৃষ্টি করা হয়েছে৷ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নদী পরিষ্কার করাই এর লক্ষ্য৷ প্রেসিডেন্ট নিজে ১,৪০০-রও বেশি সৈন্য মোতায়েন করে এই নদীর পানি পরিশোধনের নির্দেশ দিয়েছেন৷ আমরা এই সেক্টরে তাঁদের সঙ্গে এই উদ্যোগকে আরো কার্যকর করে তোলার চেষ্টা করছি৷ কারণ, তাঁরা নৌকায় করে প্রতিদিন পানি থেকে সব আবর্জনা তুলে নিচ্ছেন, যেগুলি বৃষ্টির কারণে সেখানে এসে পড়ে৷ স্থানীয় পর্যায়ে পাওয়া যায়, এমন সব উপকরণ ব্যবহার করে সমাধানসূত্র বের করাই আমাদের লক্ষ্য৷ সস্তায় দ্রুত মেরামত করা যায়, দ্রুত গড়ে তোলা যায়, এমন কিছু প্রয়োজন৷ তাই এমন ট্র্যাশ বুম বসানোর আইডিয়া আমাদের মাথায় এলো৷ নদীর উপর ভাসমান, ৬০ সেন্টিমিটার গভীর পর্যন্ত বিস্তারিত এই বাঁধ আশেপাশের সব বয়ে চলা আবর্জনা ধরে নেয়৷''
তা সত্ত্বেও প্লাস্টিক ফিশার ও সেনাবাহিনীর সামনে বিশাল চ্যালেঞ্জ রয়েছে৷ ট্র্যাশ বুম ফাঁদের প্রোটোটাইপের ক্ষমতার সীমা দ্রুত স্পষ্ট হয়ে গেছে৷ কারণ, চিতারুম নদীতে প্রতিদিন প্রায় ২,০০০ টন প্লাস্টিক ভেসে বেড়ায়৷ বিশাল মাত্রায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও আবর্জনা ব্যবস্থাপনার অভাবের কারণে প্রতিদিন কোটি কোটি বাড়িঘরের আবর্জনা বিনা বাধায় শাখানদীগুলির মাধ্যমে চিতারুম নদীতে চলে আসে৷ পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে হবে, কার্স্টেন তা জানেন৷ কার্স্টেন হিয়র্শ জানান, ‘‘এটা হলো চিকাপুন্ডুং নদী৷ এর মাধ্যমেই বান্ডুং শহরের সব জঞ্জাল চিতারুম নদীতে চলে আসে৷ সে কারণেই প্লাস্টিক ফিশার এখানে বিশাল আকারের ট্র্যাশ বুম বসানোর পরিকল্পনা করছে৷ প্রায় ৫০ মিটার দীর্ঘ এই বেড়ার উপর দিয়ে হাঁটাও যাবে৷ চিতারুম নদীতে আসার আগেই সব জঞ্জাল আটকানো সম্ভব হবে৷''
অগ্রগতির চিহ্ন
সমস্যার মাত্রা যতই কঠিন মনে হোক না কেন, কিছু অগ্রগতি অবশ্যই লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ গত দুই বছরে চিতারুম নদী থেকে হাজার হাজার টন আবর্জনা দূর করা সম্ভব হয়েছে৷ প্লাস্টিক ফিশারও এই সাফল্যে অবদান রেখেছে৷ তবে স্থানীয় পর্যায়ে নেটওয়ার্ক গড়ে না তুললে এই অসাধ্যসাধন করা সম্ভব হবে না৷
প্লাস্টিক ফিশারের প্রধান প্রযুক্তি অফিসার মোরিৎস শুলৎস তাই রামধন ইসমান্টোর ওয়ার্কশপ পরিদর্শন করছেন৷ সেখানে তিনি চিকাপুন্ডুং নদীর জন্য আরো বড় আকারের ট্র্যাশ বুম ইউনিট তৈরির কাজে অগ্রগতি খতিয়ে দেখছেন৷ রামধন ‘প্রেশাস প্লাস্টিক' নামের নেটওয়ার্কের অংশ৷ গোটা বিশ্বে এর প্রায় ৪০,০০০ সদস্য ছড়িয়ে রয়েছেন৷ প্লাস্টিক বিপর্যয় মোকাবিলার লক্ষ্যে তৃণমূল স্তরে প্রকল্পগুলিকে মদত দিতেই এই উদ্যোগ গড়ে তোলা হয়েছে৷ কারো মাথায় কোনো আইডিয়া এলে ওয়েবসাইটে একটি মানচিত্রের মধ্যে দেখা যায়, কোন সদস্য কোন উপকরণের জোগান দিতে পারেন৷ এভাবে লেজার কাটার, গুদাম বা গোটা ওয়ার্কশপের খোঁজ পাওয়া যায়৷ মোরিৎস এমন নেটওয়ার্ক নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট৷
প্লাস্টিক ফিশার কোম্পানির সিটিও মোরিৎস শুলৎস বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন৷ তিনি জানালেন, ‘‘ইস্পাতের তারের অংশ পানির মধ্যে থাকবে এবং আমরা ২০০ লিটারের দুটি ভাসমান পিপা এই দুটি অংশের উপর রাখবো৷ প্রায় ১ দশমিক ২ টন প্লবতা থাকবে৷ ফলে যথেষ্ট চাপ সামলানো যাবে৷''
স্থানীয় উপকরণের কার্যকারিতা
এই সব পিপা মূলত তৈরি পোশাক কারখানা থেকে আনা হয়েছে৷ স্থানীয় পর্যায়ে সহজে মেলে, এমন উপকরণ ব্যবহার করাই প্লাস্টিক ফিশারের নীতি৷ এ ধরনের উপকরণ সাধারণত ফেলে দেওয়া হয়৷
পরের দিন কাজ অনেক এগিয়ে গেছে৷ মোট ১৩টি বড় ট্র্যাশ বুমের মধ্যে প্রথমটি সঠিক স্থানে আনা হয়েছে৷ এই উদ্যোগ সফল হলে চিকাপুন্ডুং নদীর জঞ্জাল আর চিতারুম নদীতে পড়বে না৷ সব প্রস্তুতি শেষ৷ এবার শুধু বাঁশের মাচাসহ সেটিকে নদীতে ভাসাতে হবে৷ সত্যি সেটা কাজ করবে কিনা, সেটাই হলো প্রশ্ন৷ কার্স্টেন হিয়র্শ মনে করেন, ‘‘যেসব নদীতে বিপুলপরিমাণ জঞ্জাল ভেসে বেড়াচ্ছে, এমন পরিবেশের জন্য এটাই আমাদের সমাধানসূত্র৷ এখানে যদি সেটা কাজ করে, সেই প্রমাণের ভিত্তিতে প্রায় সব জায়গায় তা প্রয়োগ করা যাবে৷''
সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ট্র্যাশ বুম পানিতে নামানো হলো৷ প্রাথমিক পরীক্ষায় সেটি ভালোভাবে পাশ করেছে৷ তবে আসল পরীক্ষা এখনো বাকি রয়েছে৷ মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে চিকাপুন্ডুং নদী চিতারুমে গিয়ে পড়ছে৷ বর্ষার সময় ট্র্যাশ বুমকে আরো বেশি স্রোত ও প্রচুর জঞ্জাল সামলাতে হবে৷
তা সত্ত্বেও প্লাস্টিক ফিশার কোম্পানির কর্মকর্তাদের মনে কোনো দুশ্চিন্তা নেই৷ চিতারুম নদী পরিষ্কার করার সংগ্রামে আশাবাদই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার৷
টোমাস কুলিক/এসবি