সন্তান জন্মের সময় বাবার ছুটি?
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬একটা সময় ছিল যখন সংসারে বা পরিবারে নারী-পুরুষের ভূমিকা ভাগ করা ছিল৷ শিশু প্রতিপালন করতে এবং ঘর গৃহস্থালি সামলাতে হতো মহিলাদের আর পুরুষদের যেতে হতো বাইরে রোজগার করতে৷ অর্থিক দিক থেকে মেয়েদের নির্ভরতা ষোল আনা ছিল পুরুষদের ওপর৷ সেদিন আর নেই৷ একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে এখন হয়েছে অনুপরিবার৷ শিক্ষাদীক্ষা আর যোগ্যতায় মেয়েরা আজ সমান তালে পা ফেলে চলেছে পুরুষদের সঙ্গে৷ যেহেতু প্রাকৃতিক কারণে সন্তানধারণ করতে হয় মায়েদেরই, মা হিসেবে শিশুসন্তানের শারিরীক, মানসিক এবং আবেগগত দায়িত্ব মায়েদের ওপরেই বর্তায়৷ তাই সেই বাড়তি চাপ বা দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হলে পুরুষদের উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে৷ সেজন্য তাঁদের ক্ষেত্রেও পিতৃত্বকালীন সবেতন ছুটি অবশ্যই প্রাপ্য৷ এখান থেকেই শুরু হয়েছে বিতর্ক৷ পুরুষদের যদি শিশু পরিচর্যা এবং ঘর গেরস্থালির কাজে মেয়েদের সাহায্য করতে হয়, তাহলে তাঁরা কেন বাড়তি ছুটি পাবেন না?
বেশ কিছু মহিলা সাংসদ এবং নাগরিক সমাজ এই দাবিটাই কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু বিকাশ মন্ত্রী মেনকা গান্ধীর সামনে রাখেন৷ এদের যুক্তি পিতৃত্বকালীন বিশেষ ছুটি মঞ্জুর বাধ্যতামূলক করা না হলে তাতে উল্টো ফল হবে৷ লিঙ্গ বৈষম্য বাড়বে৷ শিশুসন্তানের দেখভাল করা স্রেফ ময়েদের একার দায়িত্ব হতে পারে না৷ এই প্রসঙ্গে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক বুদ্ধদেব ঘোষ কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণমন্ত্রী মেনকা গান্ধীর অনুরূপ মত ব্যক্ত করে ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘পিতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়াটা বড় কথা নয়. পিতারা সেই ছুটির সদ্ব্যবহার করছেন কিনা সেটাই আসল কথা৷
এটা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে৷ আসলে কি জানেন, আমাদের দেশে ধরেই নেওয়া হয় শিশুসন্তান প্রতিপালনের দায়দায়িত্ব মায়েদেরই, কারণ, আমাদের সমাজে পিতৃতান্ত্রিকতা অত্যন্ত প্রবল৷ তা থেকেই কথায় কথায় উঠে আসে, আমি কি চুড়ি পরে এসেছি? এই হীনমন্য মানসিকতাটা দূর করতে আগে আন্দোলন গড়ে ওঠা দরকার৷'' ডয়চে ভেলেকে সমাজ বিজ্ঞানী বুদ্ধদেব ঘোষ আরো বলেন, ‘‘দরকার পুরুষদের মধ্যে সচেতনতা জাগানো৷ গড়ে তোলা দরকার সামাজিক কালচার যাতে পুরুষ সমাজ নিজেরাই ভাবতে পারেন, শিশুসন্তান প্রতিপালনের দায়দায়িত্ব মা ও বাবার সমান৷ একা মা শুধু রাত জাগবেন, ডায়পার পালটাবেন তা-তো হয় না৷ আমি যেটা বলতে চাইছি, আগে তৈরি হোক সচেতনতা, যেমনটা হয়েছে জার্মানি বা অন্য উন্নত দেশে৷ তারপর সবেতন ছুটির প্রশ্ন৷ তা না হলে ছুটির অপব্যবহারই হবে৷ সবেতন ছুটি মানে একটা খরচের প্রশ্ন আছে, সেটা তো সমাজকেই বহন করতে হবে৷ কাজেই সেটা যাতে সার্থক হয়, সেটাও দেখতে হবে৷''
কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু বিকাশ মন্ত্রী মেনকা গান্ধী ঘোষণা করেছেন, তাঁর বিশেষ উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় মাতৃত্বকালীন সবেতন ছুটির মেয়াদ বর্তমানের ১২ সপ্তাহ থেকে বাড়িয়ে ২৬ সপ্তাহ করা হচ্ছে৷ এ সংক্রান্ত বর্তমানের আইন সংশোধনী বিলটি সংসদের পেশ করা হয় গত বর্ষাকালীন অধিবেশনে এবং উচ্চকক্ষ রাজ্যসভাতে সেটি পাশ হয়৷ এখন নিম্নকক্ষ লোকসভায় সেটি পাশ হবে সম্ভবত সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে৷ তবে সরকার তার আগেই দরকার হলে বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করে তা কার্যকর করতে চায়৷ পুরুষদের জন্য পিতৃত্বকালীন সবেতন ছুটি সম্পর্কে মেনকা গান্ধী মনে করেন, পুরুষদের সবেতন ছুটি বাড়ালেও আসল উদ্ধেশ্য সিদ্ধ হবার সম্ভবনা কম, কারণ, বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বর্তমানে যত ছুটি পুরুষরা পান, সেটাও তাঁরা ঐ সব কাজে ব্যয় করেন না৷ বাড়তি ছুটি দিলেও সেটাকে তাঁরা ‘হলিডে' বলেই গণ্য করবেন৷ সরকারের চলতি নিয়মবিধি অনুসারে সরকারি কর্মচারিরা ১৫ দিনের সবেতন ছুটি নিতে পারেন এবং সেই ছুটি অন্য ছুটির সঙ্গেও যুক্ত করতে পারেন৷ সেটার সদ্বব্যবহার করে পিতারা যদি আশা দিতে পারেন, তাহলে পিতৃত্বকালীন ছুটি বাড়ানোর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে৷ তবে বেসরকারি ক্ষেত্রে তা বাধ্যতামূলক নয়৷ কোনো কোনো কোম্পানিতে এক সপ্তাহ, বড়জোর দু'সপ্তাহ৷
কেউ কেউ এমন সংশয়ও ব্যক্ত করেছেন যে, মহিলাদের ২৬ সপ্তাহ সবেতন ছুটি দিলে ভবিষ্যতে বেসরকারি কোম্পানি, বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলিতে মহিলাদের নিয়োগ সীমিত হতে পারে৷ সবেতন ছুটির অপব্যবহার রোধে মহিলা ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রণালয় কিছু কিছু রক্ষাকবচের সংস্থান রেখেছেন৷ যেমন মাতৃত্বকালীন সবেতন ছুটির শর্ত হবে ঐ মহিলাকে ন্যূনতম সময় পর্যন্ত কাজে বহাল থাকতে হবে৷ সেটা হতে পারে এক বছর বা দু'বছর৷ জাতীয় মহিলা কমিশনের মতে, মায়েদের ওপর চাপ কমাতে ভারতে এখন পিতৃত্বকালীন ছুটি মঞ্জুর করার কথা চিন্তা করার সময় এসেছে৷
আপনি কী মনে করেন? নারীর মতো পুরুষেরও কি শিশু জন্মের পর ছুটির প্রয়োজন? লিখুন নীচের ঘরে৷