1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আত্মহত্যা ঠেকাতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৬ জুলাই ২০১৮

স্কুলের শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে মঙ্গলবার ঢাকার শাহজাহানপুর এলাকায় এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে৷ আরেক শিক্ষার্থী স্কুল ভবন থেকে পড়ে প্রাণ হারায়৷ কর্তৃপক্ষ বলছে, এটি দুর্ঘটনা৷ তবে বন্ধুদের দাবি, এটি আত্মহত্যা৷

https://p.dw.com/p/326xM
ছবি: vkara - Fotolia.com

২৪ জুলাই, মঙ্গলবার রাতে স্কুলছাত্রী সুমাইয়া আক্তার মালিহা (১৪) ঢাকার শাহজাহানপুরের নিজ বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে৷ সে শহীদ ফারুক ইকবাল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিল৷ তার একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করেছে পুলিশ৷ তাতে লেখা আছে, ‘‘আমার সুইসাইড করার কারণ একমাত্র রিমি ম্যাডাম৷ সে অযথা পরীক্ষায় আমার খাতা নিয়েছে৷ আর পরীক্ষায় কম নম্বর দিয়েছে৷ তোমরা যদি পার তাহলে সেই ম্যাডামকে মানসিক চিকিৎসা দাও, মেন্টাল হসপিটালে পাঠাও৷ ম্যাডাম আমারে অভিশাপ দিয়েছে, তাই আমার ভালো রেজাল্ট খারাপ হয়েছে৷''

পুলিশ এই সুইসাইড নোট এবং প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে শিক্ষক রিমি আক্তারকে গ্রেপ্তার করে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে৷

‘শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা এবং গঠন বোঝা জরুরি’

মালিহার চাচাতো ভাই আলমগীর মিয়া জানান, ঘটনার ১০/১২ দিন আগে তার পরীক্ষা শেষ হয়৷ মালিহার কাছ থেকেই তারা জানতে পেরেছেন, পরীক্ষার সময় স্কুলের ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষিকা রিমি আক্তার মালিহার পরীক্ষার খাতা কেড়ে নেন এবং নম্বর কম দেন৷

বিষয়টি নিয়ে মালিহা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং পরীক্ষায় তার ফল খারাপ হবে বলে ধারণা করতে থাকে৷ গত মঙ্গলবার রাতে মালিহার মা মুনমুন বেগম ছোট মেয়ে সামিহাকে নিয়ে পাশের ঘরে ছিলেন৷ মালিহা তার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে ফ্যানের সাথে ওড়না পেচিয়ে গলায় ফাঁস দেয়৷

দুর্ঘটনা, না আত্মহত্যা?

একই দিনে উত্তরা রাজউক মডেল কলেজের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী নাফিসা নেওয়াজ ইথিকা ভবনের ৪র্থ তলা থেকে পড়ে নিহত হন৷ স্কুল কর্তৃপক্ষ দাবি করছে সে পা ফসকে পড়ে যায়৷

থানা পুলিশ বলছে, তারা কোনো অভিযোগ পাননি৷ অভিযোগ পেলে মামলা নেয়া হবে৷

কিন্তু ঐ কলেজের শিক্ষার্থীরা দাবি করছেন, ইথিকা আত্মহত্যা করেছে৷ পরীক্ষার নম্বর নিয়ে সে মানসিক চাপে ছিল৷

কলেজ ভবনের ৪র্থ তলায় যাওয়ার সময় হঠাৎ সে সিঁড়ি থেকে পড়ে যায়৷ এ সময় ক্লাসের শিক্ষার্থীরা তার চিৎকার শুনতে পায় এবং ইথিকাকে ভবনের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে৷ আহত অবস্থায় তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নেয়া হয়৷ পরে তাকে সেখান থেকে সিএমএইচে নেয়ার কিছু সময় পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন৷

‘অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে রীতিমত টিসি আতঙ্কে আছেন’

জানা গেছে, প্রিটেস্ট পরীক্ষায় গণিতে ইথিকা ১০০ নম্বরের মধ্যে ৩৯ পান৷ এক নম্বরের জন্য তিনি ঐ বিষয়ে ফেল করেন৷ কিন্তু ইথিকা নম্বরপত্রে সেটাকে ৬৯ করেন৷ এটা শিক্ষকের কাছে ধরা পড়ে এবং তাকে টিসি দেয়ার হুমকি দেয়া হয়৷ যখন তাকে জোর করে প্রিন্সিপালের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন সে সিঁড়ি থেকে লাফ দেয়৷

জরিপ

বাংলাদেশে শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বাড়িতে শারীরিক শাস্তি নিয়ে ইউএনডিপি একটি জরিপ পরিচালনা করে ২০১৩ সালে৷ সাক্ষাৎকারভিত্তিক সেই জরিপে দেখা যায়, প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৯ জন জানিয়েছে যে, তারা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তির শিকার হয়েছে৷

আর ইউনিসেফের জরিপ বলছে, ২০১০ সাল পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতকরা ৯১ ভাগ শিশু শারীরিক শাস্তির শিকার হয়েছে৷ জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে বেত বা লাঠির ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে এবং ৮৭ দশমিক ৬ শতাংশ ছাত্র এই বেত বা লাঠির শিকার হয়৷

হাইকোর্টের নির্দেশনা

২০১১ সালে হাইকোর্ট শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেয়ার বিষয়টি বেআইনি এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করে৷ আর হাইকোর্ট-এর নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয় এব্যাপারে একটি পরিপত্রও জারি করে৷ এই পরিপত্রই আইন৷ বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ শিশুদের শারীরিক শাস্তি দিলে ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি হবে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে৷ অভিযোগের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ১৯৮৫-এর আওতায় অসদাচরণের অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে৷ প্রয়োজনে ফৌজদারি আইনেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে৷ কিন্তু মানসিক শাস্তির বিষয়ে কোনো কিছু স্পষ্ট করে বলা হয়নি৷

টিসি আতঙ্কে অভিভাবকরা!

বাংলাদেশ অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘স্কুল শিশুরা শারীরিক শাস্তির পাশাপাশি মানসিক পীড়ণের শিকার হচ্ছে৷ ফলে দুঃখজনক অনেক ঘটনা ঘটছে৷ অভিভাবকরা প্রতিবাদ করলে তাদের সন্তানরা শাস্তির মুখে পড়ে৷ অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে রীতিমত টিসি আতঙ্কে আছেন৷ কথায় কথায় সন্তানকে টিসি দিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়৷'' তিনি বলেন, ‘‘এনিয়ে আমরা মন্ত্রণালয়েও কয়েকবার অভিযোগ করেছি৷ কোনো কাজ হয়নি৷ উল্টো অভিভাবকদের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিকভাবে হয়রানি করা হয়৷''

‘শিক্ষার্থীদের নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক চাপে রাখা হয়’

জিয়াউল কবির দুলু আরো বলেন, ‘‘স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রধানত শিক্ষকের কাছে কোচিং করতে বা প্রাইভেট পড়তে রাজি না হওয়ায় তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করা হয়৷ আর এর প্রতিবাদ করলে টিসি দিয়ে দেয়া হয়৷''

হয়রানির অভিযোগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. মুজিবুর রহমান লাভলু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শিক্ষা হবে আনন্দের মধ্য দিয়ে৷ শিশুরা পড়াশুনা বা পরীক্ষাকে ভয় পাবেনা৷ এটাই শিক্ষার আধুনিক কৌশল৷ কিন্তু আমাদের এখানে এর উল্টো ব্যবস্থা চলছে৷ শিক্ষার্থীদের নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক চাপে রাখা হয়৷ আর এর ফলে অনেক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে৷''

তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কাছে এরকম অভিযোগও আছে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের কাছে বা কোচিং-এ না পড়লে তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়৷''

ড. লাভলু বলেন, ‘‘পরীক্ষা ভীতি এবং পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে শিক্ষার্থীরা অনেক মানসিক চাপে থাকে৷ এটা দূর করতে হবে৷ উন্নত বিশ্বে এই পরিস্থিতি এড়াতে পরীক্ষার ফল শিক্ষার্থীকে এককভাবে জানানো হয়৷ যাতে সে তার ক্লাসমেট বা বন্ধুদের কাছে খারাপ ফলের জন্য হেয় বা অপমানিত না হয়৷''

শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন

হয়রানি, চাপ বা হেনস্তার শিকার হয়ে শিক্ষার্থীদের এই আত্মহত্যাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়ার কথা বলেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট এবং হাসপাতালের শিশু কিশোর ও পারিবারিক সম্পর্ক বিভাগের চিকিৎসক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘একই চাপ বা হেনস্তার মুখে সবাই আত্মহত্যা করে না৷ কেউ কেউ করে৷ তাহলে শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা এবং গঠন বোঝা জরুরি৷ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা আলাদাভাবে জানা জরুরি৷''

তিনি বলেন, ‘‘শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক বা শারীরিক চাপ হয় এমন কোনো আচরণ কোনো শিক্ষক করতে পারবেন না৷'' আরেক প্রশ্নের জবাবে ডা. আহমেদ বলেন, ‘‘স্কুলগুলোতে নিয়োগ দেয়ার মতো বাংলাদেশে অত চাইল্ড সাইকোলজিস্ট নেই৷ তাই প্রয়োজন স্কুলের শিক্ষকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া৷ তারা যাতে বিষয়টি বুঝতে পারেন৷ তারা যেন জানেন, শিক্ষার্থীদের প্রতি কেমন আচরণ করতে হবে, কোন শিক্ষার্থী কোন ধরণের আচরণ নিতে পারবে৷ এছাড়া শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে কোনো নেতিবাচক প্রবণতা থাকলে তাদের সেই অনুযায়ী চিকিৎসকের কাছে পাঠাতে হবে৷''

এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য