১০ হাজার মানুষের আত্মহত্যা
১৩ জুন ২০১৬বাংলাদেশে গতমাসে একটি আত্মহত্যার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব পায়৷ একজন মডেল আত্মহত্যার আগে ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্টের মাধ্যে সুইসাইড নোট দিয়েছিলেন৷ এমনকি ভিডিওতে তিনি আত্মহত্যা করার চেষ্টাও দেখান৷ এরপরেই তিনি আত্মহত্যা করেন৷ বাংলাদেশে ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে এ ধরণের আত্মহত্যার ঘটনা এই প্রথম৷ পুলিশ এর মধ্যে তাঁকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে কয়েকজনতে আটকও করেছে বলেও জানা গেছে৷
ভারতের একটি হিন্দি সিরিয়ালের নায়িকা পাখির জামার মতো জামা না পেয়ে অভিমানে বাংলাদেশে কিশোরী-তরুণীদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে গত প্রায় তিন বছর ধরে৷ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেও সিরাজগঞ্জে পাখির মতো জামা না পেয়ে এক কিশোরী আত্মহত্যা করে৷
এর বাইরে নির্যাতন, ইভটিজিং বা যৌতুকের কারণেও নারীদের আত্মহত্যার খবর প্রায় প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়৷ এছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষা, বিশেষ করে এসএসি ও এইচএসসির ফলাফল প্রকাশের সময় বা তার পর পরও আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষণীয়৷
গবেষণা যা বলছে
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিচার্স বাংলাদেশ ২০১৩ সালে এক জরিপ চালিয়ে দেখে যে, প্রতিবছর দেশে গড়ে ১০ হাজার লোক আত্মহত্যা করে৷ প্রতি এক লাখে করেন ৭ দশমিক ৩ জন৷ বিভিন্ন বয়স, লিঙ্গ, পেশা এবং ভৌগলিক অবস্থানের নিরিখে ৮ লাখ ১৯ হাজার ৪২৯ জনের ওপর সরাসরি জরিপ চালিয়ে তারা এই তথ্য প্রকাশ করে৷ আর শহরের চেয়ে গ্রামে আত্মহত্যার হার ১৭ গুণ বেশি৷ গ্রামে যাঁরা আত্মহত্যা করেন, তাঁদের বড় অংশ অশিক্ষিত এবং দরিদ্র৷
জরিপে বলা হয়, নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি৷ এঁদের মধ্যে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সি নারীরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ৷ এছাড়া ২০১৪ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করেন৷
তাদের হিসেবে, ঐ বছর ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন ১০ হাজার ১২৯ জন৷ এঁদের মধ্যে একটা বড় অংশের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে৷
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করছেন ২১-৩০ বছর বয়সিরা৷ এর মধ্যেও নারীর সংখ্যা বেশি৷
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব
বাংলাদেশ পুলিশের হিসাবে, প্রতিবছর ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করছেন৷ এর বাইরে আছে ঘুমের ওষুধ খাওয়া, ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়া, রেললাইনে ঝাঁপ দেয়া৷
তাদের হিসাবে, এর বাইরে দেশের বড় বড় হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগে যত রোগী ভর্তি হয়, তার সর্বোচ্চ ২০ ভাগ আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া লোকজন৷
নারীদের আত্মহত্যার কারণ
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ আত্মহত্যার ৯৭০টি ঘটনা পর্যালোচনা করে নারীদের বেশি আত্মহত্যার কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছে৷ তাদের মতে, বাংলাদেশে নারীদের ওপর শারীরিক, যৌন ও মানসিক নির্যাতন এবং ইভটিজিং-এর ঘটনা বাড়ায় অনেকে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন৷
অবিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হওয়া অথবা স্বেচ্ছায় যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পর গর্ভধারণের কারণে অনেকে আত্মহত্যা করেন৷ বেশির ভাগ নারী আত্মহত্যা করেছেন গলায় দড়ি দিয়ে আর পুরুষেরা কীটনাশক খেয়ে৷
২০১৩ সালে বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক ‘প্রথম আলো' তাদের পত্রিকায় প্রকাশিত ২০টি আত্মহত্যার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে৷ তাতে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে নানা দিক উঠে এসেছে৷
কারণগুলো এরকম – যৌতুকের কারণে নারীরা আত্মহত্যা করেছেন, স্বামী মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে সন্তানকে হত্যা করে আত্মঘাতী হয়েছেন মা৷ স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়ে লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যা করেছে৷ এছাড়া অন্তত দু'জন রোগের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন৷ একজন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে, অন্যজন মতিঝিল এজিবি কলোনিতে শ্বাসকষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিজের গলা কেটে ফেলেন৷ পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পাওয়ায় নীলফামারীতে এক কিশোর আত্মহত্যা করে৷ ঐ বছর শুধু উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিনই আত্মহত্যার চেষ্টা করা কমপক্ষে ২৭ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি হন, যাঁদের মধ্যে একজন মারা যান৷
আত্মহত্যা প্রবণ এলাকা
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি৷ আত্মহত্যার চরম ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হিসেবে ঝিনাইদহ পরিচিত৷ স্থানীয় পুলিশ ও হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ঝিনাইদহে ২০১০ সালে আত্মহত্যা করেছে ৩৮০ জন আর চেষ্টা করেছে ২১০৯ জন; ২০১১ সালে আত্মহত্যা করেছে ৩০৯ জন, চেষ্টা করেছে ২৮৪৯ জন; ২০১২ সালে আত্মহত্যা করেছে ২৯৫ জন, চেষ্টা করেছে ২৫৮৩ জন; ২০১৩ সালে আত্মহত্যা করেছে ৩১১ জন, চেষ্টা করেছে ২৬৩৯ জন; ২০১৪ সালে আত্মহত্যা করেছে ৩০৩ জন, আর চেষ্টা করেছে ২৪০৯ জন এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে আত্মহত্যা করেছে ৩৬৩ জন আর চেষ্টা করেছে ২৬০০ জনের ওপরে৷
ঝিনাইদহে প্রতিবছর গড়ে আত্মহত্যা করে ৩৫০ জন৷ আর আত্মহত্যার চেষ্টা করেন দুই হাজারেরও বেশি মানুষ৷ যাঁরা আত্মহত্যা করেন তাঁদের অধিকাংশই নারী৷
নারী নির্যাতন, পারবিারিক কলহ, সংসারে অশান্তি, অসুস্থতা, বাবা-মার ওপর অভিমান, প্রেম ঘটিত ব্যাপার, কৃষকের ঘরে কীটনাশকের সহজ লভ্যতা ও তুচ্ছ ঘটনায় আবেগ প্রবণ হয়ে এই জেলার মানুষ হরহামেশা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়৷
বিশেষজ্ঞরা যা বলেন
বাংলাদেশ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আত্মহত্যার দু'টি ধরন আছে – পরিকল্পিতভাবে এবং আবেগ তাড়িত হয়ে আত্মহত্যা৷ বাংলাদেশে অধিকাংশ আত্মহত্যার ঘটনা আবেগ তাড়িত হয়ে ঘটে৷ এ কারণে তরুণ-তরুণীরাই বেশি আত্মহত্যা করেন৷ তাছাড়া নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি হওয়ার কারণ আমাদের আর্থ সামাজিক অবস্থা৷ নির্যাতন, ইভটিজিং, যৌতুক, অবমাননা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা না থাকা ইত্যাদি৷''
তিনি জানান, ‘‘আসলে শহর বা গ্রাম নয় আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি কম হয় অঞ্চলভেদে৷ আত্মহত্যার উপকরণের সহজলভ্যতা আত্মহত্যা একটি বড় কারণ৷ আবার আত্মহত্যার ঘটনা প্রচার হলে বা কেউ প্রত্যক্ষ করলে অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হতে পারে৷''
চিকিৎসকেরা বলছেন, যাঁরা আত্মহত্যা করেন তাঁদের ৯৫ ভাগই কোনো না-কোনো মানসিক রোগে ভোগেন৷ তাজুল ইসলামের কথায়, ‘‘এই মানসিক বোগের সঠিক চিকৎসা করা গেলে আত্মহত্যা কমবে৷ মাদকাসক্তি আত্মহত্যা প্রবণতার জন্য একটি বড় কারণ৷ তাই মাদকাসক্তদের চিকিৎসা এবং মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া দরকার৷''
বাংলাদেশে মানসিক রোগের চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ২০০৷ জেলা পর্যায়েই মানসিক রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই৷ শুধু ২২টি মেডিক্যাল কলেজ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও পাবনার হাসপাতালে মানসিক রোগের চিকিৎসা হয়৷ ডা. তাজুল ইসলাম জানান, ‘‘যত লোক আত্মহত্যা করেন, তার অন্তত ১০ গুণ লোক আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেঁচে যান৷ কিন্তু তাঁরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকেন৷ সঠিক মানসিক চিকিৎসা না হলে তাঁদের বড় একটি অংশ আবারো আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারেন৷''
আত্মহত্যা নিয়ে গোটা বিশ্বে উদ্বেগ আছে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) হিসাবে, ১৫-৪৪ বছর বয়সি জনগোষ্ঠীর মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের একটি হলো আত্মহত্যা৷ ডাব্লিউএইচও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্বে প্রতিবছর সাড়ে ১৫ লাখ মানুষ আত্মঘাতী হবেন৷ আত্মহত্যার চেষ্টা চালাবেন এর কমপক্ষে ১০ থেকে ২০ গুণ মানুষ৷
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্ররোচনা ও আত্মহনন একটি ফৌদজারী বা শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ তবে যিনি আত্মহত্যা করেন, তাঁকে আর এই শাস্তি দেয়ার সুযোগ থাকে না৷
আত্মহত্যা বন্ধে কি কি উদ্যোগ নেয়া জরুরি বলে আপনার মনে হয়? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে