1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

১০ হাজার মানুষের আত্মহত্যা

হারুন উর রশীদ স্বপন, ঢাকা১৩ জুন ২০১৬

গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার লোক আত্মহত্যা করেন, যাঁদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি৷ বয়সের হিসেবে তরুণ-তরুণীরাই বেশি আত্মঘাতী হচ্ছেন৷ তবে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন এরচেয়ে আরো ১০ গুণ বেশি মানুষ৷

https://p.dw.com/p/1J4On
বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করছেন ২১-৩০ বছর বয়সিরা
প্রতীকী ছবিছবি: Fotolia/Jochen Schönfeld

বাংলাদেশে গতমাসে একটি আত্মহত্যার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব পায়৷ একজন মডেল আত্মহত্যার আগে ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্টের মাধ্যে সুইসাইড নোট দিয়েছিলেন৷ এমনকি ভিডিওতে তিনি আত্মহত্যা করার চেষ্টাও দেখান৷ এরপরেই তিনি আত্মহত্যা করেন৷ বাংলাদেশে ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে এ ধরণের আত্মহত্যার ঘটনা এই প্রথম৷ পুলিশ এর মধ্যে তাঁকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে কয়েকজনতে আটকও করেছে বলেও জানা গেছে৷

ভারতের একটি হিন্দি সিরিয়ালের নায়িকা পাখির জামার মতো জামা না পেয়ে অভিমানে বাংলাদেশে কিশোরী-তরুণীদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে গত প্রায় তিন বছর ধরে৷ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেও সিরাজগঞ্জে পাখির মতো জামা না পেয়ে এক কিশোরী আত্মহত্যা করে৷

এর বাইরে নির্যাতন, ইভটিজিং বা যৌতুকের কারণেও নারীদের আত্মহত্যার খবর প্রায় প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়৷ এছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষা, বিশেষ করে এসএসি ও এইচএসসির ফলাফল প্রকাশের সময় বা তার পর পরও আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষণীয়৷

তাজুল ইসলাম

গবেষণা যা বলছে

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিচার্স বাংলাদেশ ২০১৩ সালে এক জরিপ চালিয়ে দেখে যে, প্রতিবছর দেশে গড়ে ১০ হাজার লোক আত্মহত্যা করে৷ প্রতি এক লাখে করেন ৭ দশমিক ৩ জন৷ বিভিন্ন বয়স, লিঙ্গ, পেশা এবং ভৌগলিক অবস্থানের নিরিখে ৮ লাখ ১৯ হাজার ৪২৯ জনের ওপর সরাসরি জরিপ চালিয়ে তারা এই তথ্য প্রকাশ করে৷ আর শহরের চেয়ে গ্রামে আত্মহত্যার হার ১৭ গুণ বেশি৷ গ্রামে যাঁরা আত্মহত্যা করেন, তাঁদের বড় অংশ অশিক্ষিত এবং দরিদ্র৷

জরিপে বলা হয়, নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি৷ এঁদের মধ্যে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সি নারীরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ৷ এছাড়া ২০১৪ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করেন৷

তাদের হিসেবে, ঐ বছর ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন ১০ হাজার ১২৯ জন৷ এঁদের মধ্যে একটা বড় অংশের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে৷

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করছেন ২১-৩০ বছর বয়সিরা৷ এর মধ্যেও নারীর সংখ্যা বেশি৷

পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব

বাংলাদেশ পুলিশের হিসাবে, প্রতিবছর ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করছেন৷ এর বাইরে আছে ঘুমের ওষুধ খাওয়া, ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়া, রেললাইনে ঝাঁপ দেয়া৷

তাদের হিসাবে, এর বাইরে দেশের বড় বড় হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগে যত রোগী ভর্তি হয়, তার সর্বোচ্চ ২০ ভাগ আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া লোকজন৷

নারীদের আত্মহত্যার কারণ

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ আত্মহত্যার ৯৭০টি ঘটনা পর্যালোচনা করে নারীদের বেশি আত্মহত্যার কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছে৷ তাদের মতে, বাংলাদেশে নারীদের ওপর শারীরিক, যৌন ও মানসিক নির্যাতন এবং ইভটিজিং-এর ঘটনা বাড়ায় অনেকে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন৷

অবিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হওয়া অথবা স্বেচ্ছায় যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পর গর্ভধারণের কারণে অনেকে আত্মহত্যা করেন৷ বেশির ভাগ নারী আত্মহত্যা করেছেন গলায় দড়ি দিয়ে আর পুরুষেরা কীটনাশক খেয়ে৷

২০১৩ সালে বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক ‘প্রথম আলো' তাদের পত্রিকায় প্রকাশিত ২০টি আত্মহত্যার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে৷ তাতে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে নানা দিক উঠে এসেছে৷

কারণগুলো এরকম – যৌতুকের কারণে নারীরা আত্মহত্যা করেছেন, স্বামী মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে সন্তানকে হত্যা করে আত্মঘাতী হয়েছেন মা৷ স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়ে লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যা করেছে৷ এছাড়া অন্তত দু'জন রোগের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন৷ একজন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে, অন্যজন মতিঝিল এজিবি কলোনিতে শ্বাসকষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিজের গলা কেটে ফেলেন৷ পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পাওয়ায় নীলফামারীতে এক কিশোর আত্মহত্যা করে৷ ঐ বছর শুধু উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিনই আত্মহত্যার চেষ্টা করা কমপক্ষে ২৭ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি হন, যাঁদের মধ্যে একজন মারা যান৷

আত্মহত্যা প্রবণ এলাকা

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি৷ আত্মহত্যার চরম ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হিসেবে ঝিনাইদহ পরিচিত৷ স্থানীয় পুলিশ ও হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ঝিনাইদহে ২০১০ সালে আত্মহত্যা করেছে ৩৮০ জন আর চেষ্টা করেছে ২১০৯ জন; ২০১১ সালে আত্মহত্যা করেছে ৩০৯ জন, চেষ্টা করেছে ২৮৪৯ জন; ২০১২ সালে আত্মহত্যা করেছে ২৯৫ জন, চেষ্টা করেছে ২৫৮৩ জন; ২০১৩ সালে আত্মহত্যা করেছে ৩১১ জন, চেষ্টা করেছে ২৬৩৯ জন; ২০১৪ সালে আত্মহত্যা করেছে ৩০৩ জন, আর চেষ্টা করেছে ২৪০৯ জন এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে আত্মহত্যা করেছে ৩৬৩ জন আর চেষ্টা করেছে ২৬০০ জনের ওপরে৷

ঝিনাইদহে প্রতিবছর গড়ে আত্মহত্যা করে ৩৫০ জন৷ আর আত্মহত্যার চেষ্টা করেন দুই হাজারেরও বেশি মানুষ৷ যাঁরা আত্মহত্যা করেন তাঁদের অধিকাংশই নারী৷

নারী নির্যাতন, পারবিারিক কলহ, সংসারে অশান্তি, অসুস্থতা, বাবা-মার ওপর অভিমান, প্রেম ঘটিত ব্যাপার, কৃষকের ঘরে কীটনাশকের সহজ লভ্যতা ও তুচ্ছ ঘটনায় আবেগ প্রবণ হয়ে এই জেলার মানুষ হরহামেশা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়৷

বিশেষজ্ঞরা যা বলেন

বাংলাদেশ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আত্মহত্যার দু'টি ধরন আছে – পরিকল্পিতভাবে এবং আবেগ তাড়িত হয়ে আত্মহত্যা৷ বাংলাদেশে অধিকাংশ আত্মহত্যার ঘটনা আবেগ তাড়িত হয়ে ঘটে৷ এ কারণে তরুণ-তরুণীরাই বেশি আত্মহত্যা করেন৷ তাছাড়া নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি হওয়ার কারণ আমাদের আর্থ সামাজিক অবস্থা৷ নির্যাতন, ইভটিজিং, যৌতুক, অবমাননা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা না থাকা ইত্যাদি৷''

তিনি জানান, ‘‘আসলে শহর বা গ্রাম নয় আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি কম হয় অঞ্চলভেদে৷ আত্মহত্যার উপকরণের সহজলভ্যতা আত্মহত্যা একটি বড় কারণ৷ আবার আত্মহত্যার ঘটনা প্রচার হলে বা কেউ প্রত্যক্ষ করলে অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হতে পারে৷''

চিকিৎসকেরা বলছেন, যাঁরা আত্মহত্যা করেন তাঁদের ৯৫ ভাগই কোনো না-কোনো মানসিক রোগে ভোগেন৷ তাজুল ইসলামের কথায়, ‘‘এই মানসিক বোগের সঠিক চিকৎসা করা গেলে আত্মহত্যা কমবে৷ মাদকাসক্তি আত্মহত্যা প্রবণতার জন্য একটি বড় কারণ৷ তাই মাদকাসক্তদের চিকিৎসা এবং মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া দরকার৷''

বাংলাদেশে মানসিক রোগের চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ২০০৷ জেলা পর্যায়েই মানসিক রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই৷ শুধু ২২টি মেডিক্যাল কলেজ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও পাবনার হাসপাতালে মানসিক রোগের চিকিৎসা হয়৷ ডা. তাজুল ইসলাম জানান, ‘‘যত লোক আত্মহত্যা করেন, তার অন্তত ১০ গুণ লোক আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেঁচে যান৷ কিন্তু তাঁরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকেন৷ সঠিক মানসিক চিকিৎসা না হলে তাঁদের বড় একটি অংশ আবারো আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারেন৷''

আত্মহত্যা নিয়ে গোটা বিশ্বে উদ্বেগ আছে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) হিসাবে, ১৫-৪৪ বছর বয়সি জনগোষ্ঠীর মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের একটি হলো আত্মহত্যা৷ ডাব্লিউএইচও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্বে প্রতিবছর সাড়ে ১৫ লাখ মানুষ আত্মঘাতী হবেন৷ আত্মহত্যার চেষ্টা চালাবেন এর কমপক্ষে ১০ থেকে ২০ গুণ মানুষ৷

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্ররোচনা ও আত্মহনন একটি ফৌদজারী বা শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ তবে যিনি আত্মহত্যা করেন, তাঁকে আর এই শাস্তি দেয়ার সুযোগ থাকে না৷

আত্মহত্যা বন্ধে কি কি উদ্যোগ নেয়া জরুরি বলে আপনার মনে হয়? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য