শহুরে বুলি আওড়ে হবে না, চাই সামাজিক সংহতি
১২ নভেম্বর ২০১৮এগুলো দেখে ঢাকার রাস্তায় চলে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের কয়েক দিনের মিছিল-মিটিং৷ পরে আবার সব আগের মতোই৷ তবে তখনও অপেক্ষা থাকে নতুন কোনো জনপদে হিন্দুর ঘরে শ্বাপদের হানার৷
সারা বছর নিয়মিত এই হামলা, অগ্নিসংযোগ আরো ব্যাপকতর রূপ নেয় বাংলাদেশে নির্বাচন এলে৷ ভোটের আগে-পরে চলে হিন্দুদের উপর আঘাত৷ তার কোনো ব্যত্যয় নেই৷ এভাবে হামলা নির্যাতন চলে এলেও তা বন্ধে নেই শক্ত কোনো পদক্ষেপ, তা সে আওয়ামী লীগ বা যে-ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন৷ সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে দিনাজপুর-যশোরে আগুনে পোড়া ঘর সরকারি খরচে বানিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ তবে হামলাকারীদের বিচার হয়নি৷ শাস্তি হয়নি এর এক যুগেরও বেশি সময়ের আগের অপকর্মের৷
২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারানোর পর দেশব্যাপী হামলা-নির্যাতন হয় হিন্দুদের ওপর, ঘটে ধর্ষণের মতো অপরাধও৷ ওই নির্বাচনের পর সহিংসতায় তিনশ'র বেশি মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি তিন হাজারের বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, সমানে চলে লুটপাট-অগ্নিসংযোগ৷
এর দীর্ঘ দিন পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ওই নির্বাচনোত্তর সহিংসতা ও নির্যাতনের ঘটনা তদন্তের জন্য হাই কোর্টের নির্দেশে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠিত হয়৷ তদন্তে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর প্রথম সারির অনেক নেতাকে ওই সহিসংতার জন্যে দায়ী করা হলেও তার বিচার এগোয়নি৷
এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিই নির্বিঘ্নে হিন্দুদের ওপর হামলার পথ করে দিচ্ছে৷ ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহতের কর্মসূচির আগুন গিয়ে পড়েছে হিন্দুদের ঘরে৷ কোনো কারণ ছাড়াই নিরীহ মানুষের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ ভোট দেয়নি বলে নয়, ভোট দিতে যাতে কেন্দ্রে না যান সেজন্য আক্রান্ত হয়েছেন তাঁরা৷
নির্বাচন আসে, ভোটে ক্ষমতার পালাবদল বা আবারও পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতাসীনদের আসন পাকা হয়৷ তো ভাই, এখানে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হবে কেন? আর বিনা কারণে তাঁদের উপর এই হামলার বিচার কেনইবা করবেন না?
শুধু হিন্দু পরিবারে জন্ম নেওয়ার কারণে এভাবে দিনের পর দিন মার খাওয়ার এই কষ্ট বহু পুরানো৷ একাত্তর দেখে আসা অধ্যাপক জাফর ইকবাল মাঝে একটি কলামে লিখেছিলেন, ‘‘যে দেশকে নিয়ে আমরা এত গর্ব করি, সেই দেশটি আসলে তেতাল্লিশ বছরে এক ইঞ্চিও সামনে অগ্রসর হয়নি৷'' এই উপলব্ধির পেছনে যে বাস্তবতা, তা তুলে ধরে তিনি লেখেন, ‘‘১৯৭১ সালে আমরা গ্রামে লুকিয়ে আছি, তখন দেখেছি একজন হিন্দু মা তাঁর শিশুসন্তানকে বুকে চেপে ধরে স্বামীর পিছু পিছু ছুটে যাচ্ছেন, তাঁদের চোখ-মুখের সেই উদভ্রান্ত অসহায় দৃষ্টি আমি কখনো ভুলতে পারব না৷ তেতাল্লিশ বছর পর এই বাংলাদেশে এখনও একজন অসহায় হিন্দু মা তাঁর সন্তানকে বুকে চেপে প্রাণ বাঁচানোর জন্যে ছুটে যাচ্ছেন৷''
বেদনা আর এই হাহাকারের পুনরাবৃত্তি আমি চাই না৷ আমার মতো অনেকেই চান না৷ তবে তার জন্য কী দরকার? ঘটনা ঘটার পরে দলবেঁধে কান্না আর রাস্তা কাঁপানো প্রতিবাদ? তার দরকার নেই, তা বলছি না৷ তবে সবার আগে দরকার প্রতিরোধ, এই ঘটনা যেন না ঘটে, সেজন্য সমাজের মধ্য থেকে প্রতিহত যেন করা হয় সেই ব্যবস্থা করা৷
শুধু হামলা হয়, আর অন্যরা চেয়ে দেখে – এই চিত্রই সব জায়গায় নয়৷ এর বিপরীত উদাহরণও আছে এবং তা ঘটেছে আমার চেনা পরিসরে, নড়াইলের একটি গ্রামে৷ ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সারা দেশে হিন্দুদের ওপর হামলা, সম্পত্তি দখলের যে হিড়িক পড়ে তার আঁচ লেগেছিল সেখানেও৷ কিন্তু ওই গ্রামের মুসলমানরাই তা প্রতিহত করেছিলেন৷ লাঠি হাতে লড়ে রুখে দিয়েছিলেন লোভীকে৷
গ্রামের খুবই শান্তশিষ্ট সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন শান্তি দাস৷ বিএ পাস করে কিছুদিন বাইরে চাকরি করে ফিরে আসেন গ্রামে৷ পল্লী চিকিৎসক হিসেবে মানুষের সেবা করতেন ওই অজপাড়া গাঁয়ে৷ ২০০১ সালের নির্বাচনের পর তাঁর বাড়ির উঠানের মধ্যে টিনের ঘর তোলেন মারকুটে এক প্রতিবেশী৷ জাল দলিল নিয়ে এই কম্ম করেছিলেন তিনি৷ বিষয়টি গড়িয়েছিল স্থানীয় সাংসদ, সে সময় বিএনপি থেকে নির্বাচিত বাবু ধীরেন্দ্রনাথ সাহা পর্যন্ত৷ কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না৷ দখল তিনি ছাড়বেন না৷ তার এই জবরদখল মেনে নিতে না পারে জোটবদ্ধ হয়েছিল গ্রামের অপরাপর মুসলমানরা৷ তাঁদের সম্মিলিত প্রতিরোধে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি৷
হিন্দু-মুসলমানের এই বন্ধন যদি প্রতিটি বসতিতে থাকে, তাহলে কে কাকে আক্রমণ করবে? এই সামাজিক সম্প্রীতি ও সংহতিই পারে সাম্প্রদায়িক নিপীড়নহীন নতুন বাংলাদেশের জন্ম দিতে৷ তাই গ্রামে যেতে হবে, কথা বলতে হবে মানুষের সঙ্গে৷ শুধু শহরে বসে কান্নাকাটি আর জোরালো স্লোগানে ফল মিলবে না৷ প্রান্তের ওই মানুষের মধ্যে বোধ জাগ্রত করতে সবাইকেই সে দিকে ছুটতে হবে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷