নির্বাচনের ভয়ে সংখ্যালঘুরা
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮রবিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এই সমাবেশের ঘোষণা দেয়া হয়৷ সমাবেশ হবে দুপুর ১টায়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে৷ ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘু সংগঠনগুলোর জাতীয় সমন্বয় কমিটিভুক্ত ২১টি সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে এই মহাসমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছে৷ সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান৷
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত সোমবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সমাবেশে একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংখ্যালঘুরা কী ভাবছে, তাদের দাবিগুলো কী এগুলোকে আমরা রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল ও জোট এবং সরকারের কাছে তুলে ধরবো৷''
তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচন কিন্তু আমাদের কাছে উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে না৷ এটা আসে বিপর্যয়ের শঙ্কা নিয়ে৷ কারণ, আমরা লক্ষ্য করেছি, অতীতে ৯০-এর পরবর্তী যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, স্থানীয় বা জাতীয় যে নির্বাচনই হোক, শুধুমাত্র ২০০৮-এর সংসদ নির্বাচন ছাড়া প্রতিটি নির্বাচনকে ঘিরে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ শুরু হয় এবং নির্বাচনের পরও অনেক দিন ধরে তা চলে৷ সেই সময়ে আমরা প্রশাসন, রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্রের একটা নির্বিকার ভূমিকা সব সময় লক্ষ্য করি৷ এ প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে, আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা আমাদের বক্তব্য তুল ধরবো৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমরা সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন পাশের দাবি তো তুলবোই, আর সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে দায়মুক্তি সংস্কৃতি অব্যাহত আছে৷ আমরা চাইব, সেখান থেকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি মুক্তি পাক৷''
রবিারের সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, ‘ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, হামলা কমে এলেও নির্যাতন-নিপীড়নের ধারা আজও অব্যাহত আছে৷ সারাদেশে উপাসনালয়ে আবারও আক্রমণ শুরু হয়েছে৷ আমরা এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই এবং এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের পাশাপাশি দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি জানাই৷''
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন:
২০০১ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশের বরিশাল, বাগেরহাট, পাবনা ও নড়াইলসহ বিভিন্ন জেলায়ব্যাপক সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে৷ এরপর থেকে একযোগে বিভিন্ন সংখ্যালঘু নির্যাতন কিছুটা কমে এলেও তা থামেনি৷ ২০১২ সালের অক্টোবরে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর বড় ধরনের হামলা হয়৷ ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরে হিন্দুদের শতাধিক বাড়ি-ঘরে হামলা-ভাঙচুর এবং লুটপাট করা হয়৷ অন্তত ১০টি মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়৷হিন্দু পল্লিতে নারী-পুরুষকে বেধড়ক পেটানো হয়৷ ২০১৭ সালের নভেম্বরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয় রংপুরের গঙ্গাচড়ার ঠাকুরপড়া এলাকায়৷ ওই ঘটনার পর সারাদেশে আরো অন্তত পাঁচটি মন্দিরে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে৷
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালের প্রথম তিন মাসেই প্রায় তিনগুণ সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে৷ জানুয়ারি , ফেব্রুয়ারি, মার্চ এই তিন মাসে ৮২৫০টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে৷ এর মধ্যে হত্যা, আহত, অপহরণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত, গণধর্ষণ, জমিজমা, ঘরবাড়ি, মন্দির, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও উচ্ছেদের ঘটনা রয়েছে৷ ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ২৬১টি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে৷ আর ১৫৬২টি প্রতিষ্ঠান, পরিবার ও ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হন৷ কিন্তু ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত প্রথম তিন মাসে সংখ্যালঘুদের ওপর কমপক্ষে ৭৩২টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, যা আগের বছরের প্রায় তিনগুণ৷ এতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৫৬৬ টি, যা আগের এক বছরের তুলনায় ছয়গুণেরও বেশি৷ এ সময়ে ১০ জন নিহত, ৩৬৬ জন আহত এবং ১০ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন৷ জোরপূর্বক ধর্মান্তরের অভিযোগ রয়েছে ২টি৷ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮ জন৷ জমিজমা, ঘরবাড়ি, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, দখল ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ৬৫৫টি৷ ২২টি পরিবারকে উচ্ছেদের হুমকি দেয়া হয়ে৷
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ) তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ‘‘বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা বেড়েছে৷'' সংস্থাটি বলছে, ‘‘ভূমি দখলের ক্ষেত্রে হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা আক্রমনের শিকার হন৷ ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বার বার আক্রমনের শিকার হয়েছেন৷
সংখ্যালঘু নির্যাত কেন বন্ধ হয় না
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ না হওয়ার জন্য রাষ্ট্রকেই দায়ী করেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘ মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলো৷ যারা রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করল, তারা বৌদ্ধ৷ প্রতিক্রিয়ায় দুই-তিনটি ঘটনা ঘটলো৷ বাংলাদেশে কয়েকজন বৌদ্ধ সাধুর ওপর হামলা হলো৷রাষ্ট্র, আমরা চিৎকার করে উঠলাম৷ এরপর গত দেড়-দুই বছরে কিন্তু আমরা বৌদ্ধদের ওপর আর কোনো হামলা ঘটনা ঘটতে দেখিনি৷ আমি বলতে চাই, রাষ্ট্র যদি মিন করে, রাষ্ট্র যদি চায়, বড় মাত্রার কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে না৷ রাষ্ট্রেকে চাইতে হবে৷ এটা সবক্ষেত্রে৷ ''
তিনি বলেন, ‘‘সর্বশেষ রংপুরের ঘটনায় সাত দিন ধরে ক্যাম্পেইন করে তারপর হামলা করা হলো৷ সবাই সব কিছু জানে৷ তারপর হামলার দুই-তিন ঘণ্টা পর এসে প্রশাসন বলে আমরা কিছু জানতাম না৷ তাই বলছি, রাষ্ট্র মিন করে কিনা৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা বলি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায়৷ এটা ক্ষমতা নয়, দায়িত্ব৷ ক্ষমতা শব্দটি ওদেরকে নষ্ট করে দেয়৷ আমি প্রধানমন্ত্রী হবো, আমি পুলিশ কমিশনার হবো, এটা আমার দায়িত্ব৷ জনগণের কাছ থেকে একজন ভোট নিয়েছেন, আরেকজন বেতন নিয়েছেন৷ এটা ওনাদের দায়িত্ব৷ ওনারা যদি দায়িত্ব পালনকে মিন করেন, সব ঠিক হয়ে যাবে৷''