শব্দদূষণের কারণে বধির হয়ে যাচ্ছেন অনেকে
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ডয়চে ভেলে: শব্দদূষণের প্রধান কারণ কী?
অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু: বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে শব্দদূষণের প্রধান কারণ, ঢাকা শহরে যে গাড়ি চলে তার মধ্যে বাস বা ট্রাকের যে শব্দ হয় অথবা এগুলোর হর্ন – তা শব্দদূষণ তৈরি করে৷ এছাড়া কলকারখানার যে শব্দ বা নির্মাণাধীন ভবনে যে পাইলিং হচ্ছে, সেটাও শব্দদূষণ তৈরি করছে৷ এছাড়া যেখানে মিউজিক ফেসটিভেল হচ্ছে, সেখানে উচ্চস্বরে মাইকে গান বাজানো হচ্ছে৷ এর মাধ্যমেও শব্দদূষণ হয়৷
বাংলাদেশে শব্দদূষণের মাত্রা কেমন?
সর্বশেষ এক গবেষণায় দেখা গেছে, নর্মালি এই মাত্রা হওয়া উচিত ৬০-এর কম এনবিএম৷ কিন্তু ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায়, যেমন নিউমার্কেটের সামনে ওভারব্রিজের নীচে, অথবা শাহবাগ বা গুলিস্তানে যদি যান, তাহলে দেখবেন সেখানে এনবিএম ১১০ থেকে ১২০ পর্যন্ত ওঠে৷ এটা কখনোই ৯০-এর নীচে নামে না৷ এই সাউন্ডটা আসলে অনেকগুণ বেশি৷ সাধারণভাবে মনে হতে পারে ৬০ থাকার কথা৷ তাই ৯০ উঠলে আর কত বেশি হবে? আসলে এটা কিন্তু লগস্কেলের পরিমাণ৷ অর্থাৎ, আসলে এই মাত্রাগুলো কয়েক হাজারগুণ বেশি৷
আপনি তো নাক, কান ও গলার রোগী দেখেন৷ এই অঙ্গগুলোর ক্ষতির জন্য শব্দদূষণ কতটা দায়ী?
শব্দদূষণের কারণে অনেক রোগীই আসছেন৷ আমি মনে করি, এক তৃতীয়াংশ মানুষ শব্দদূষণের কারণে আক্রান্ত৷ একটা গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে শব্দদূষণের যে মাত্রা, সেটা যদি অব্যহত থাকে, তাহলে ২০২৩ সাল নাগাদ এক তৃতীয়াংশ মানুষ এর দ্বারা আক্রান্ত হবেন৷ তাঁরা বধিরতায় আক্রান্ত তো হবেনই, এছাড়া তাঁদের ক্ষুধামন্দা, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, কাজে মনোযোগী হতে না পারা, কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ করাসহ হৃদরোগের সমস্যাও হতে পারে৷
কত ভাগ মানুষ শব্দদূষণের কারণে আক্রান্ত হচ্ছেন? এ বিষয়ে কোনো গবেষণা আছে?
বাংলাদেশে এ নিয়ে কোনো সরাসরি গবেষণা নেই৷ ২০১৬ সালের একটি গবেষণা আছে, সেখানে দেখা গেছে যে, সরাসরি এক তৃতীয়াংশ মানুষ এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত৷ এর মধ্যে কম বা বেশি ক্ষতিও আছে৷ সবাই যে একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনটা নয়৷ কারো বেশি হচ্ছে, আবার কারো কম ক্ষতি হচ্ছে৷ তবে ক্ষতি সকলেরই হচ্ছে৷
এই ধরনের গবেষণা তো আরো হওয়া উচিত৷ তা সেটা হচ্ছে না কেন?
বাংলাদেশে আসলে গবেষণার কিছু সমস্যা আছে৷ আমাদের গবেষণার অর্থ বরাদ্দ হয় বছরের শেষ দিকে৷ কিন্তু অর্থ বরাদ্দ হলেও গবেষণা করা যাচ্ছে না৷ আসলে গবেষণার কাজ শুরু হয় জানুয়ারি থেকে৷ কিন্তু অর্থ যদি আপনি ডিসেম্বরে পান, তাহলে কীভাবে কাজ করবেন? টাকা পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে হয়৷ ধরুন, আপনি একটা গবেষণার প্রস্তাব দিলেন, যেটা কিনা আপনি এক বছর ধরে করবেন৷ প্রস্তাব দিলেন৷ কিন্তু সেটা পাস হবে কিনা তা আপনি জানেন না৷ ১০, ২০, ৩০ লাখ টাকা বা তারও বেশি খরচ হয়ে থাকে একটা গবেষণায়৷ এখন কারো পক্ষে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে গবেষণা শুরু করা তো সম্ভব না৷ কারণ, আপনি জানেন না সেটা পাস হবে কিনা৷ ফলে ঠিকমতো গবেষণা করা যাচ্ছে না৷
শব্দদূষণের সামাজিক প্রভাব কেমন?
শব্দদূষণের সামাজিক প্রভাব প্রচণ্ড৷ স্কুল, কলেজ বা হাসপাতালে পাশে যে শব্দ হয়, সেখানে মানুষ মনোযোগ দিতে পারে না৷ তার মনোযোগে ঘাটতি ঘটায় এই শব্দ৷ এই শব্দের কারণে কাজের পারফরম্যান্স বা পড়াশোনায় মনোযোগ অনেকাংশে কমে যায়৷ এছাড়া আগেই বলেছি, ক্ষুধামন্দা, হৃদরোগ হচ্ছে শব্দদূষণের কারণে৷ শব্দ মানুষের ব্রেনে সরাসরি আঘাত করে৷ ফলে, মানুষের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে৷ সব সময় সে অস্থিরতায় ভুগছে৷ সোশ্যাল ভায়োলেন্সেরও একটা কারণ এই শব্দদূষণ৷ আপনি দেখবেন, দু'টো গাড়ি যদি পাশাপাশি চলে আর তাদের মধ্যে যদি একটার গায়ে অন্যটা লেগে যায়, তবে দু'জন গাড়ি চালকই উচ্চস্বরে তর্কাতর্কি করতে থাকেন৷ কারণ, উচ্চ শব্দের কারণে তাঁদের মেজাজ এমনিতেই বিগড়ে থাকে৷ এটা নিয়েও আমাদের দেশে কোনো গবেষণা নেই৷ ভারতের কাশ্মীরে একটা গবেষণা হয়েছিল, সেখান থেকেই আমি এই কথাগুলো বললাম৷
শব্দদূষণে আর্থিক ক্ষতি নিয়ে কোনো গবেষণা আছে?
এমন কোনো গবেষণা আমাদের দেশে নেই৷ বিশেষ করে কলকারখানাগুলোতে অসম্ভব শব্দ হয়৷ সেখানে শ্রমিকরা যে কাজ করেন, তাঁদের জন্য ‘সাউন্ড প্রুফ রুম' বা ‘লো ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড' থাকার কথা, সেটা কখনোই দেখা হয় না৷ তাই শব্দদূষণের কারণে অনেক মানুষ বধির হয়ে যাচ্ছেন৷ একজন মানুষ যখন বধির হয়ে যান, তখন তিনি যে কাজটা করতেন, সেটা করতে পারেন না৷ তার ওপর আমাদের দেশে যে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা, সেটাও দেয়া হয় না৷ উন্নত বিশ্বে কিন্তু এটা কঠোরভাবে দেখা হয়৷সেখানে শব্দদূষণের কারণে কারো চাকরি ছাড়তে হলে তিনি ক্ষতিপূরণটা নিশ্চিতভাবে পান৷ আমাদের দেশে আর্থিক ক্ষতিপূরণের কোনো ব্যবস্থা নেই৷ অথচ এতে ক্ষতির দিকটা কিন্তু ব্যাপক৷
ঢাকা শহরে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কেন?
এখানে কেউ কোনো নিয়ম মানেন না৷ সবাই ভেপু বাজাচ্ছেন, হাইড্রোলিক হর্নব্যবহার করছেন৷ রাস্তায় রাস্তায় পুরনো গাড়ি বিপুল পরিমাণ শব্দ তৈরি করে৷ এটা তো কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে না৷ এখানে বিল্ডিং বানানো হচ্ছে, কিন্তু সেটা থেকে যে শব্দ তৈরি হচ্ছে, সেটা নিয়ন্ত্রণের জন্য নেট দিয়ে জায়গাটা ঘেরা বা অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই৷ সমানে ড্রিল মারা হচ্ছে৷ অথচ কেউ সেগুলো দেখছেন না৷
শব্দদূষণের ধর্মীয় কোনো প্রভাব আছে?
এই বিতর্ক সারা বিশ্বেই আছে৷ শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, খোলা মাঠে যে জনসভা করা হচ্ছে মাইক বাজিয়ে, সেটাও তো ভয়াবহ শব্দদূষণ করছে৷ এটা নিয়ে যাঁরা চিন্তাবিদ, তাঁরা চিন্তা করতে পারেন৷
এই শহরে নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে৷ তাদের জন্য কোনো ভালো খবর দিতে পারেন?
অবশ্যই তাদের জন্য ভালো খবর দেয়া যায়৷ প্রথমত হাইড্রলিক হর্ন পরিহার করতে হবে৷ পাশাপাশি ছোট গাড়ি বা ছোট বাস তুলে দিয়ে বড় বাস বা বেশি করে ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হবে৷ পাশাপাশি হাসপাতাল, স্কুল-কলেজের আশেপাশে শব্দের মাত্রা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে৷ এগুলো করা আমাদের দেশেও সম্ভব৷
উচ্চ আদালতের অনেক আদেশ আছে৷ সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না কেন?
বাংলাদেশে ভালো ভালো আইন আছে৷ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর শব্দদূষণের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইন করেছে৷ কিন্তু আইনেরপ্রয়োগ ঠিকমতো হচ্ছে না৷ প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সেগুলো ঠিকমতো প্রয়োগ করতে পারছে না৷ আর আমরা সবাই এটার অংশ৷ পুলিশ, প্রশাসন, এমনকি আমার মতো ডাক্তারদেরও এতে ‘পার্ট' আছে৷ কিন্তু তারপরও এটার প্রয়োগ করা যাচ্ছে না৷ এটাই আমাদের ব্যর্থতা৷
এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷