1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘লোকসংস্কৃতি' জীবনের সংস্কৃতি

২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

একটি দেশের বা একটি জাতির আত্মপরিচয় তার লোকসংস্কৃতি৷ আর বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিই এ দেশের মূল সংস্কৃতির ভিত্তি৷ এখানকার সাহিত্য, জীবনবোধ, মুক্তিযুদ্ধ, জীবনাচরণ লোকসংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে৷

https://p.dw.com/p/2ps6j
মেলা
ছবি: DW/M. M. Rahman

সাধারণ মানুষের ভাষা, জীবনবোধ, বিনোদন, সাহিত্য, পেশা – এ সব নিয়েই গড়ে ওঠে ‘লোকসংস্কৃতি'৷ এই সংস্কৃতির মধ্যে থাকে সহজিয়া সুর৷ কোনো কৃত্রিমতা থাকে না লোকসংস্কৃতিতে৷ এটা সহজাত, সহজিয়া আর স্বাভাবিক বহতা নদীর মতো৷ পোশাকি সংস্কৃতির বিপরীতে এক শক্তিশালী সোঁদা মাটির গন্ধ ভরা স্বকীয় সংস্কৃতি৷ এর কোনো বিনাশ নাই৷ আছে আধুনিক সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার উদারতার ইতিহাস৷ তাছাড়া এই সংস্কৃতির ভাষাও লোকজ৷ যাকে বলা হয় লোকভাষা৷ সাধারণ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মুখে, কথায়, ভাষার ব্যবহারে, লেখায় এর প্রকাশ৷

গ্রামীণ জীবনের আনন্দ-বেদনার কাব্য, জীবনবোধের প্রকাশ৷ তাঁদের পোশাক, খাবার, প্রার্থনা, পূজা-পার্বণ, ফসল, ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বাসস্থান, বাহন, জীবন সংগ্রাম, দ্বন্দ্ব, বিরহ – এ সবই লোকসংস্কৃতিকে রূপ দেয়৷ লোকসংস্কৃতির মাধ্যমে তার সামগ্রিক প্রকাশ ঘটে৷ লোকগানে, কবিতায়, সাহিত্যে, উৎসবে, খেলাধুলাতেও প্রকাশ পায় লোকসংস্কৃতি৷

আছে প্রবাদ-প্রবচন, খনার বচন, লোককথা৷ এরমধ্যে আছে প্রকৃতির কথা, ঋতুর কথা, ভালো-মন্দের কথা, জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় দিকের কথা৷ এ সবের সঙ্গে আছে বিজ্ঞানের সম্পর্ক, আছে যুক্তির সম্পর্কও৷ লোকসংস্কৃতির অনেক উপাদানের রূপ-প্রকৃতির বিচার করে একে চারটি প্রধান ধারায় ভাগ করা হয়: বস্তুগত, মানসজাত, অনুষ্ঠানমূলক ও প্রদর্শনমূলক৷

গ্রামীণ জনপদের লোকসমাজ জীবনধারণের জন্য যেসব দ্রব্য ব্যবহার করে, তা বস্তুগত সংস্কৃতির উপাদান৷ যেমন বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠা, আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, যানবাহন, সকল পেশার যন্ত্রপাতি, কুটিরশিল্প, সৌখিন দ্রব্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য, ঔষধপত্র ইত্যাদি৷

মৌখিক ধারার লোকসাহিত্য মানসজাত লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত৷ লোককাহিনি, লোকসংগীত, লোকগাথা, লোকনাট্য, ছড়া, ধাঁধা, মন্ত্র, প্রবাদ-প্রবচন প্রভৃতি গদ্যে-পদ্যে রচিত মৌখিক ধারার সাহিত্য৷

অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনমূলক লোকসংস্কৃতির মধ্যে লোকনাট্য, যাত্রা, নৃত্য ও খেলাধুলা প্রধান৷ বাউল, গম্ভীরা, জারি গানের সঙ্গে নাচ, সারি গানের সঙ্গে সারি নাচ, লাঠি খেলার সঙ্গে লাঠি নাচ, খেমটা গানের সঙ্গে খেমটা নাচ এবং ঘাটু গানের সঙ্গে ঘাটু নাচ ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ হোলির গীত, গাজীর গীত, মাগনের গীত, বিবাহের গীত, হুদমার গীত প্রভৃতি লোকসংস্কৃতির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ৷

‘বাংলাদেশে কৃষি ও শ্রমজীবী মানুষকে কেন্দ্র করেই লোকসংস্কৃতির উদ্ভব’

হস্তশিল্প লোকসংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ ভুবন৷ এ সব হস্তশিল্পে মানুষের মেধা, নৈপুণ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়৷ যেমন নকশিকাঁথায় পায় শিল্পী মনের প্রকাশ৷ বেতশিল্প, বাঁশশিল্প, কাঠশিল্প, চামড়াশিল্প, বুননশিল্প সমৃদ্ধ করেছে লোকসংস্কৃতিকে৷ মসলিনের যুগ পেরিয়ে আজকের জামদানি লোকশিল্পেরই অবদান৷

সাধারণভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাসরত ‘অক্ষরজ্ঞানহীন' ও ঐতিহ্যের অনুসারী বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ‘লোক' বলে অভিহিত করা হয়৷ এই ধরনের জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, সমাজব্যবস্থা, বিশ্বাস-সংস্কার ও প্রথা-প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সংস্কৃতিতে মিল আছে৷ মার্কিন লোককলাবিদ স্টিথ থমসন এই লোক-মানসিকতার অভিন্ন গতি-প্রকৃতি দেখিয়েছেন তাঁর গবেষণায়৷ বাংলার কৃষক ফসল তোলার সময় এক গোছা ধান মাঠ থেকে এনে ঘরের চালে ঝুলিয়ে রাখেন৷ একে বলা হয় ‘লক্ষ্মীর ছড়া'৷ বিশ্বের নানা দেশের কৃষকসমাজেও একই প্রথা চালু আছে৷ কোথাও তা ‘শস্যরানি', কোথাও ‘শস্যপুতুল', কোথাও বা ‘শস্যমাতা' নামে অভিহিত৷ তাই লোকসংস্কৃতির একটা বিশ্বজনীন ও সর্বকালীন রূপ আছে৷

লোকসংস্কৃতির গবেষক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. রহমান হাবিব মনে করেন, ‘‘সাধারণের জীবন ধর্মই হলো লোকসংস্কৃতি৷ আর বাংলাদেশে কৃষি ও শ্রমজীবী মানুষকে কেন্দ্র করেই লোকসংস্কৃতির উদ্ভব৷ গ্রামীণ জীবনের একটি যাত্রাপালা সহজ এবং সাধারণ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ এটারই পোশাকি রূপ হলো নাটক৷ তাই সহজেই বলা যায় আধুনিক সংস্কৃতি তথা সাহিত্যের ভিত্তিই হলো লোকসংস্কৃতি বা লোকসাহিত্য৷''

‘লোকসংস্কৃতির নানা বিকৃত রূপ আমরা আজকাল দেখতে পাই’

তিনি বলেন, ‘‘পার্থক্যটি হলো ভাষার৷ লোকসংস্কৃতির ভাষা লোকজ বা আঞ্চলিক৷ লালন ফকির বা হাসন রাজার গান লোকগান৷ লোকজ ভাষার ব্যবহার আছে তাঁদের গানে৷ নজরুল বা রবীন্দ্রনাথের কবিতা-গানে কখনো কখনো আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার থাকলেও, সেটা প্রধান নয়৷ তাছাড়া লোকসাহিত্যে সাধারণের জীবন প্রাধান্য পায়৷ আধুনিক সাহিত্য কিন্তু সেখান থেকেই তার উপাদান নেয়৷''

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে লোকসংস্কৃতিই এখনো প্রধান৷ এর প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেনি বরং বেড়েছে৷ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা একাডেমি থেকে লোকভাষা ও আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রকাশ করেছেন ষাট-এর দশকে৷ গত পাঁচ-সাত বছরে বাংলা একাডেমি ৬৪ জেলার লোককথা, প্রবাদ, লোকসাহিত্যের ওপর ৬৪টি বই প্রকাশ করেছে৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, নজরুল বিশ্ববিদ্যায় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ফোকলোর' বিভাগ চালু হয়েছে৷''

তিনি জানান, ‘‘আমাদের লোকসংস্কৃতির চর্চা আরো বাড়াতে হবে৷ এই চর্চাই পারে বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধ করতে৷ তাই এই সংস্কৃতির চর্চাই আমাদের সংস্কৃতিবান করবে৷''

লোকসংস্কৃতির আরেকজন গবেষক নর্দান ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল করিম বলেন, ‘‘লোকসংস্কৃতির নানা বিকৃত রূপ আমরা আজকাল দেখতে পাই৷ বাউল গানের সুরকে বিকৃত করা হয়৷ লোকগানের সুর বিকৃত করা হয়৷ এটা আমাদের জন্য বড় ক্ষতি৷ এটা যাঁরা করেন, তাঁরা জীবনসংস্কৃতির ক্ষতি করেন৷ আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ – এ সব তো লোকসংস্কৃতিরই অবদান, লোকসংস্কৃতির ফসল৷''

তিনি বলেন, ‘‘লোকসংস্কৃতি মানে হলো লোকজ্ঞান৷ ডাক ও খনার বচন৷ আজকে আমরা কৃষির উন্নয়নে এই লোকজ্ঞান ব্যবহার করছি৷ ‘ফোকলোর' মানে লোকজ্ঞান, ফোক লার্নিং, ফোক উইজডম, যা আমাদের সমৃদ্ধ করে৷ আমাদের গভীর জীবনবোধের দিকে নিয়ে যায়৷''

তাঁর কথায়, ‘‘বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম ফোকলোর-এর ‘লিভিং মিউজিয়াম'৷ বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতি আমাদের৷ কিন্তু আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে এখনো একটা ‘ফোকলোর ইন্সটিটিউট' করতে পারিনি৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সেটা লোকসংস্কৃতির অবদান৷ আমাদের এই সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আমাদের তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে৷ তাঁদের চর্চার ব্যবস্থা করতে হবে৷ তা না হলে আমরা জাগব কীভাবে?''

এ বিষয়ে আপনার কোনো মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷