রোহিঙ্গা নির্যাতনের অভিযোগে এইচআরডাব্লিউকেই পুলিশের তোপ
১৮ জানুয়ারি ২০২৩এপিবিএনের প্রধান, অতিরিক্ত আইজিপি ড. হাসান উল হায়দার এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, "এইচআরডাব্লিউ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়নি। যখনই আমরা অপরাধীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাই, তখনই অপপ্রচার চালানো হয়।”
মঙ্গলবার প্রকাাশিত এইচআরডাব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়, এপিবিএনের সদস্যরা বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাদের কাছে ঘুস দাবি করেন। ঘুস না দিলে তাদের নির্যাতন করা হয়। তারা বলছে, আটক হওয়া থেকে রেহাই দিতে এপিবিএনের সদস্যরা একেকজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর কাছে ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা দাবি করেন। আটকের পর কাউকে ছাড়ার বিনিময়ে দাবি করা হয় ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা।
এই সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি জনিয়েছে সংস্থাটি। এইচআরডাব্লিউর এশিয়া বিষয়ক গবেষক শায়না বাইচনার বলেছেন, "রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ দাতাদের আরো সক্রিয় হতে হবে। বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়ে চাপ দিতে হবে।” তার কথা, "ক্যাম্পে যাদের রোহিঙ্গাদের রক্ষা করার কথা, রোহিঙ্গারা তাদের হাতেই অন্যায়-অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।”
এইচআরডাব্লিউর দেয়া কিছু উদাহরণ
প্রতিবেদনে কথিত নির্যাতন ও চাঁদাবাজির শিকার বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। তাদের একজন ২০ বছর বয়সি আলী জাকের। তিনি অভিযোগ করেন, কয়েকদিন আগে তিনি তার অসুস্থ ভাইয়ের চিকিৎসা প্রতিবেদন নিয়ে হাসপাতাল থেকে ক্যাম্পে ফিরছিলেন। চেকপোস্টে এপিবিএনের এক সদস্য তাকে আটক করেন। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তাকে চড় মারেন ওই সদস্য। তিনি বলেন, ‘‘ওই সময় এপিবিএনের সদস্যরা আমার কাছ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন রেখে দেন। এই ঘটনা প্রকাশ করলে আমাকে দেখে নেয়ারও হুমকি দেন।”
সিতারা বিবির বয়স ৪৫ বছর। তিনি অভিযোগ করেন, "ঘুস নেয়ার ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটে।'' সিতারা বিবি দাবি করেন, তিনি তার ছেলের বিয়ের সময় এপিবিএন সদস্যদের তিন হাজার টাকা ঘুস দিয়েছিলেন। তার কথা, ‘‘যদি তাদের এই টাকা না দেয়া হতো, তাহলে তারা আমার ছেলের বিরুদ্ধে মাদক পাচারের মিথ্যা মামলা দিতো।''
এরকম আরো কয়েকজনের সাক্ষাৎকার রয়েছে এইচআরডাব্লিউর প্রতিবেদনে। তার মধ্যে সায়েদুল নামে একজন বৃদ্ধকে আটকের পর মুক্তি দিতে এক লাখ টাকা ঘুস দাবির অভিযোগও আছে। ওই টাকা দিতে না পারায় তাকে ইয়াবা পাচারের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় বলে তার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন। সায়েদুল এখনো কারাগারে আছেন।
আর নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা এইচআরডাব্লিউর কাছে অভিযোগ করেছেন, এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে যেতে হলেও পুলিশকে তাদের চাঁদা দিতে হয়। রাতে ক্যাম্পে ঢুকতে চাঁদা দিতে হয়। এর প্রতিবাদ করলে নির্যাতন করা হয়।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে আর্মড পুলিশের তিনটি ব্যাটালিয়ন। ২০২০ সালের জুলাই মাসে তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়। ক্যাম্পগুলোতে ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা বসবাস করেন। এইচআরডবিøউ'র দাবি," সেখানকার শরণার্থী ও মানবিক সহায়তাকর্মীরা জানিয়েছেন, এপিবিএন দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে নিরাপত্তা পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। পুলিশের নির্যাতন বাড়তে থাকা এবং ক্যাম্পে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে এই পরিস্থিতি হচ্ছে।” ক্যাম্পের কয়েকজন বাসিন্দা এপিবিএন কর্মকর্তা, সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং বিভিন্ন চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ থাকার দাবি করেছেন বলে জানায় এইচআরডাব্লিউ।
মানবাধিকার কর্মীর পর্যবেক্ষণ
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর সাধারণ সম্পাদক নূর খান রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ে অনেক দিন ধরে কাজ করছেন। তিনি বলেন, "আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো, এপিবিএনকে দায়িত্ব দেয়ার পর সেখানে চাঁদাবাজি ও শক্তি প্রয়োগের কিছু ঘটনা আমাদের নজরেও এসেছে।”
তার কথা, "ক্যাম্পে নানা ধরনের বাধা তৈরি করা হয়েছে, নীতি কৌশল নেয়া হয়েছে, যা চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। শরণার্থী ক্যাম্প একটি স্পর্শকাতর জায়গা। এই ধরনের জায়গায় দায়িত্ব দেয়ার আগে এপিবিএন সদস্যদের যথাযথ প্রশিক্ষণের দরকার ছিল। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কী ধরনের আচরন করা উচিত, কী ধরনের আচরণ করা উচিত নয় সে ব্যাপারে তাদের প্রশিক্ষিত করা উচিত ছিল। কিন্তু সারাদেশে পুলিশ যেভাবে শক্তি প্রয়োগ করে, একইভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করলে সেটা নিয়ে তো প্রশ্ন উঠবেই।”
তিনি মনে করেন, "এই প্রশিক্ষণ অতি দ্রুত দেয়া দরকার। আর যে ঘটনাগুলোর অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নিলে এই ধরনের ঘটনা অনেক কমে আসবে।”
যারা অভিযোগ করেছে, তারা আসলে কেমন?
এপিবিএনের প্রধান, অতিরিক্ত আইজিপি ড. হাসান উল হায়দার বলেন, "এখানে (ক্যাম্পে) অনেক দল-উপদল আছে। সেখানে কিলিং হয়, চাঁদাবাজি হয়। আমাদের লোকজনও আহত হয়েছে, গুলিবিদ্ধ হয়েছে। যখনই আমরা অ্যাকশনে যাই, যারা অপরাধ করে, তারা তখনই অপপ্রচার চালায় আমাদের লোকজন তাদের ধরেছে। যে উদাহরণগুলো তারা (এইচআরডাব্লিউ) দিয়েছে, সবগুলোতেই মামলা হয়েছে, থানা পুলিশ তদন্ত করছে,অ্যারেস্ট হয়েছে। এপিবিএন কাউকে বন্দি করে সেখানে রাখবে, তার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের কোনো হাজতখানাই নেই।”
তার কথা, "ঘুসের অভিযোগ হলো বায়বীয় অভিযোগ। এর কোনো প্রমাণ নাই, ডকুমেন্ট নাই। যে কেউ এই অভিযোগ করতে পারে। বাংলাদেশে ঘুসের অভিযোগ করা সবচেয়ে সহজ।”
তার মতে, "এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে এইচআরডাব্লিউ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়নি। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি বাহিনির বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ করলো, কিন্তু আমাদের সাথে তারা কথাই বলেনি। আমাদের কাছে জানতে চাইতে পারতো। আমরা ব্যখ্যা দিতে পারতাম। আমাদের সব ডকুমেন্ট আছে।”