রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন, রোহিঙ্গাদেরই সন্দেহ
২৫ মার্চ ২০২১কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কাঁটাতারের বেড়া তুলে দেওয়ার জন্যই এই আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে বলে আমরা সন্দেহ করছি৷’’
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, গত ২২ মার্চের অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৬১ হেক্টর এলাকা ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং প্রায় ১০ হাজার ঘর পুড়ে যায় বলে স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা গেছে৷ আগুনে পরিবারের সদস্য হারিয়েছেন এমন ১৭ জন প্রত্যক্ষদর্শী এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাথে কথা বলেছে তারা৷ তাদের ভাষ্যমতে, শিবিরের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া থাকার কারণে পরিবারের সদস্যরা দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারেনি৷ আগুনে ৫ বছর বয়সি সন্তান হারানো এক ব্যক্তি হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, ‘‘৯ নম্বর ক্যাম্প থেকে সবাই যখন পালাচ্ছিল, তখন আমি আর আমার স্ত্রী আমাদের ছেলেকে হারিয়ে ফেলি৷ হারিয়ে যাওয়ার পর আমাদের খুঁজতে আমাদের থাকার জায়গায় ফিরে গিয়েছিল আমার ছেলে৷ সেখানে তার পুড়ে যাওয়া মরদেহ পাই আমরা৷ বেড়া না থাকলে মানুষ অন্য পথ দিয়েও বের হতে পারতো৷’’
হিউম্যান রাইট ওয়াচের প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ শামছু-দ্দৌজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা দিন-রাত কাজ করছি, তাদের সব সময় খাবার দিচ্ছি, অথচ কিছু মানুষ এগুলো নিয়ে বসে থাকে৷ যারা এগুলো বলছে, তারা কি মিয়ানমারকে কিছু বলেছে যে, তাদের ফেরত নিয়ে যাও৷ দিনাজপুরেও তো আজকে একটি ঘরে আগুন লেগে তিন জন মারা গেছে৷ অথচ এখানে ৬০ হাজার মানুষকে আমরা উদ্ধার করেছি৷ আগুনের যে ভয়াবহতা ছিল সে অনুযায়ী হতাহত কম হয়েছে৷ আমি তো আগেই বলেছি, কাঁটাতারের বেড়ার কারণে হতাহত বেশি হওয়ার কোনো কারণ নেই৷’’
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাসহ বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসেব অনুযায়ী আগুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৫ জন মারা গেছেন৷ তবে সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ১১ জন৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে বলছে, চারশর মত মানুষ সেখানে এখনও নিখোঁজ আছে, যদিও এই তথ্য নিশ্চিত করেনি বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ৷
পালংখালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘‘কাঁটাতারের বেড়া না থাকলে রোহিঙ্গারা পুরো দেশেই ছড়িয়ে পড়বে৷ আমার ইউনিয়নে অধিবাসী ৫০ হাজার৷ আর এখানে রোহিঙ্গা আছে সাড়ে ৮ লাখ৷ তাহলেই বোঝেন এই বেড়া না থাকলে কী অবস্থা হবে৷ যদি কাঁটাতারের বেড়ার পাশে কোনো লাশ পাওয়া যেতো তাহলেও কেউ বলতে পারতো বেড়ায় আটকে মারা গেছে৷ কিন্তু লাশগুলো তো ওদের ঘরের মধ্যেই পাওয়া গেছে৷ এই মৃত্যুর সঙ্গে কাঁটাতারের বেড়ার সম্পর্ক কী? এটা আসলে কিছু মানুষের অপপ্রচার৷ আমি তো আসলে সন্দেহ করি কাঁটাতারের বেড়া তুলে দেওয়ার জন্যই এই আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে৷’’
এই কাঁটাতারের বেড়া তুলে দেওয়ার পক্ষে নন বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘বিপুল সংখ্যক মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ৷ তাদের তো উন্মুক্ত স্থানে রাখা যায় না৷ তাহলে তারা তো দেশের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে৷ দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হবে৷ ফলে আমি মনে করি, ওই এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া থাকাই উচিত৷’’
তবে বেড়া থাকার কারণে বিশেষ করে বৃদ্ধ, শিশু এবং শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিরা নিরাপদ স্থানে সরে যেতে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে বলেই মনে করছে হিউম্যান রাইট ওয়াচ৷ বালুখালি ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. শাকেরও ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘কাঁটাতারের বেড়ার কারণে আমাদের অনেকেরই বের হতে সমস্যা হয়েছে৷ এমনকি গ্রামবাসীও আগুন নেভাতে এগিয়ে আসতে পারেনি৷ এই বেড়া না থাকলে অনেক গ্রামবাসী এসে সহযোগিতা করতে পারতেন৷ আগুন এত ছড়িয়ে পড়তো না৷ আমাদের ক্ষয়ক্ষতিও অনেক কমে যেতো৷’’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কর্মকর্তা ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, ক্যাম্পের ভেতরে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বেড়ার মধ্যে রেখে শরণার্থীদের জীবন বাঁচানোর কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ৷ কর্তৃপক্ষের উচিত মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সাথে কাজ করা এবং শরণার্থীদের চলাফেরার স্বাধীনতাকে সম্মান করা৷ প্রত্যদর্শীদের উদ্ধৃত করে সংগঠনটি বলছে, বেড়ার কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এবং জরুরি সেবা দিতে আসা যানবাহন প্রবেশেও সমস্যা হয়েছে৷