যৌনলালসা কেন বিকৃতরূপে?
১২ জুলাই ২০১৯যৌনলালসা হাজির হচ্ছে তার সমস্ত বিকৃতরূপ নিয়ে৷ এর কারণ আসলে কী? সমাধানই-বা কীসে?
চলতি বছরের মে মাসের ঘটনা৷ টাঙ্গাইলের মধুপুরে শতাধিক বছরের এক বৃদ্ধা ধর্ষণের শিকার হন৷ ধর্ষকের বয়স ১৫ বছর৷ তার পরের মাসের আরেক ঘটনা চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির৷ ৯ মাস বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ করা হয়৷ এখানে ধর্ষক ছাব্বিশের তরুণ৷ দুটো ঘটনাই গণমাধ্যমে এসেছে৷ আসামিরা গ্রেপ্তার হয়েছে৷ বিচার প্রক্রিয়া চলছে৷ এমন আরো অনেক ঘটনা থেকে যায় অপ্রকাশিত৷ থেকে যায় বিচারের বাইরে৷
প্রকাশিত ঘটনা নিয়েই পরিসংখ্যান সাজায় সরকারি আর বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)৷ এমনি এক হিসেব দিয়েছে এনজিও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন৷ ধর্ষণ নিয়ে তাদের তথ্যমতে, এই বছর প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশে আক্রান্ত হয়েছে ৩৯৯ জন শিশু৷ যাদের কেউ ধর্ষিত হয়েছে, কেউবা ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে৷ আর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক হিসেবমতে, এই ছয় মাসে এ ধরনের ঘটনার কারণে শিশু হত্যার ঘটনার সংখ্যা ২১৷
শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ- সব বয়সের কেউ না কেউ আজ ভূক্তভোগী৷ ধর্ষণের এ পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিলেন বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার চেয়ারম্যান ফরীদ উদ্দীন মাসউদ৷ তিনি বললেন, ‘‘আমি এটা দেখছি মানুষের একটা সামাজিক এবং মানসিক বিকৃতি৷ এটা মৌলিকভাবে নৈতিকতার অভাব থেকে হয়েছে৷ তবে এটা যদি শুধু যৌনলালসার কারণে হত তাহলে শুধুমাত্র যৌন লালসাই পূরণ করত৷ কিন্তু ধর্ষণের পর আবার হত্যাও করছে৷ এই হত্যা করাটা হচ্ছে সমাজের প্রতি তার একটা জিঘাংসা৷’’
যুগের বাজে হাওয়া…
প্রযুক্তি হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে দুনিয়া৷ একই বিশ্বগ্রামের বাসিন্দা হয়ে উঠছে সবাই৷ পৃথিবীর সব রূপ-রং-রস-গন্ধ নিতে পারছে সবাই৷ কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই তা হজমের বদলে বদহজম হচ্ছে৷ বিষয়টির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান বললেন, ‘‘এটা একটা ক্রান্তিকাল৷ হয়তো আরো কিছুদিন পর সমাজের এরকম নেগেটিভ এক্টিভিটিজের মধ্য থেকেই একটা জাগরণ তৈরি হবে৷ আমাদের সমাজব্যবস্থায় একদিকে নানা উপকরণ চলে এসেছে৷ টাকাপয়সা হাতে আসায় আমাদের অ্যাকটিভিটি চেঞ্জ হয়ে গেছে৷ তারপর পর্নোগ্রাফি বা অনেক নেগেটিভ কিছু আমাদের সমাজের মধ্যে ঢুকছে৷ আগে একসময় এগুলো সমাজে ছিলো না৷ যার কারণে এগুলো এখন ডাইজেস্ট করা সহজ হচ্ছে না৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘এখনকার রিলেশনগুলো আলগা হয়ে গেছে৷ এটা এক ধরনের মহামারির মত হয়ে গেছে৷ একজন করতে পারছে আর একজন করতে পারছে না৷ এখানে তৈরি হচ্ছে ঝামেলা৷ এটা আধুনিক ব্যবস্থার ফলে যে হচ্ছে সেটা নয়- তবে আধুনিক ব্যবস্থায় নিমজ্জিত জীবনাচারণে যেতে গিয়ে এমন সবকিছু হয়ে যাচ্ছে৷ আর পর্ণোগ্রাফি- এটা সবাইকে গ্রাস করছে৷ একেবারে শিক্ষক, হুজুর, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সর্বস্তরকে গ্রাস করে ফেলেছে৷’’
একই প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হকের ভাষ্য, ‘‘মানুষের হাতে একটা মেশিন (মোবাইল ফোনসেট) আছে৷ সে সেখানে বসে বসে পর্নোগ্রাফি দেখে৷ এই মেশিন কী উপকার করলো? একটা ১৬ বছরের মেয়ে বা ২০ বছরের ছেলে পর্নোগ্রাফি দেখে৷ সে সেটা ইমপ্লিমেন্ট করার চেষ্টা করবে না? একজন বুড়া মানুষ৷ মসজিদে যায়৷ সে বাড়ি বসে পর্নোগ্রাফি দেখে৷ এভাবেই সমাজটা গোল্লায় চলে গেছে সেটা বুঝতে হবে৷’’
বিকারের পেছনে লুকোছাপা?
শুধু বঙ্গীয় সমাজে নয়, পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই যৌনতা রাখঢাক বা লুকোছাপার বিষয়৷ এর পেছনে শুধু ধর্ম নয় হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতিও একটা ব্যাপার৷ গোপনীয়তা কৌতুহল বাড়ায়৷ আর কৌতুহল থেকেই জন্ম নেয় অনেক অপরাধ, বিকারগ্রস্ত করে দেয় মানুষকে৷ ধর্ষণের সঙ্গে এমন কোনো বিষয় যুক্ত?
এমন প্রশ্নে অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক বললেন, ‘‘রাখঢাক তো অনেক আগে থেকেই ছিলো৷ বেশি উন্মোচন করলেই যে ভালো হবে সেটা নয়৷ প্রথম কথা হচ্ছে মানুষের নৈতিকতাবোধে ধস নেমেছে৷ আমাদের সোসাইটি সব সময় রাখঢাক নিয়ে এসেছে৷ তখন কিন্তু এ ধরণের আদিমতা, অত্যাচার, অনাচার ছিলো না৷ এখন কেনো হচ্ছে? কারণ এখন যতবেশি উন্মোচিত হচ্ছে ততো বেশি বিনষ্ট হচ্ছে৷ সুতরাং রাখঢাক কতটুকু করতে হয় আর কতুটুকু করতে হয় না- সেটারও একটা ব্যাল্যান্স থাকা দরকার৷ আপনি টোটালি উন্মোচন করে দিবেন, সেটা যে ভালো হবে সেটা তো কোনো কথা না৷ প্রতিটা সমাজের একটা অনুশাসন থাকবেই৷’’
শিক্ষালয়েই মিলতে পারে সমাধান
বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আর মাদ্রাসা- সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই মাঝে মাঝে আসে নেতিবাচক খবর৷ কোনো কোনো শিক্ষক ধর্ষক রূপে আবির্ভূত হন৷ তাদের কেউ মাওলানা৷ কেউবা খ্যাতনামা স্কুলে করছিলেন শিক্ষকতা৷ কেউ জাতীয় পর্যায়ের সুধীজন৷ তবু বিদ্যাপিঠ থেকেই যৌন বিকার থেকে মানুষের মুক্তির সংগ্রাম দেখতে চায় সমাজকর্মীরা৷ এর অংশ হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে তারা যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য শিক্ষার বিষয়-আশয় দেখতে চায়৷ গত কয়েক বছরে এমন কিছু উদ্যোগও দেখা গেছে৷
এতে আশার আলো দেখছেন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান৷ তার ভাষ্যমতে, ‘‘এটাই তো মৌলিক শিক্ষা৷ আমাদের এই আধুনিকায়ন সমাজে এসবের ইমপ্লিমেন্ট করতে হবে৷ যেহেতু আমাদের পুরাতন সংস্কৃতি কাজ করছে না৷ সেহেতু যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য শিক্ষা না দিলে আমাদের বাচ্চারা জানবে কি করে- কোনটা সেফ, কোনটার কি ফল, কোনটায় তার ক্ষতি, তার বিপদ৷’’
পাঠ্যপুস্তকে যৌনশিক্ষার বিস্তার নিয়ে ভিন্নমত দিলেন কথাসাহিত্যিক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক৷ তার যুক্তি হচ্ছে- ‘‘বিদেশে তো ১৩ বছরে যৌন বিষয়ক শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে, সেখানে কী আনম্যারিড প্রেগন্যান্সি হচ্ছে না? তাদের ওই যৌন শিক্ষায় কী লাভ হয়েছে? আমি মনে করি প্রত্যেকটা সোসাইটিতে যৌন শিক্ষা দিলেই যে ছেলেমেয়েরা ভালো হয়ে যাবে সেটা নয়৷ মানুষের ভেতরে যে আবেগের সৃষ্টি হয় সেটার নিরসন হওয়া দরকার৷ ছেলেমেয়েদের নানাবিধ এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজের মধ্যে ব্যস্ত রাখতে হবে৷’’
অন্যদিকে যৌনশিক্ষা বিষয়ক পাঠদানে সতর্কতার দিকটি নিয়ে বললেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম ফরীদ উদ্দীন মাসউদ৷ তিনি জানালেন, ‘‘যৌন শিক্ষা বলতে যেমন আমাদের দেশের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় কিশোর বয়সে অনেক কিছুই শেখাই৷ যেমন বয়োসন্ধি, ঋতুর বিষয়- যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ে শেখানো হয়৷ এতে কিন্তু মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের উপর বিরূপ কোনো প্রভাব পড়ে না৷ আসলে এক্ষেত্রে এমন কিছু শব্দ নির্বাচন করা দরকার যাতে এটা মানুষকে লালসার দিকে এগিয়ে না নিয়ে যায়৷ এক্ষেত্রে শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে৷ তাই যৌন শিক্ষার বিরুদ্ধে আমি নই৷ কিন্তু শব্দ চয়নে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে৷’’