যোগী বনাম অখিলেশের লড়াইয়ের ফল কী হবে?
৭ মার্চ ২০২২বারাণসীর গদৌলিয়া মোড় থেকে দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে যেতে গেলেই একটা পাঁচমেশালি শব্দ এসে কানে ধাক্কা দেয়। এই রাস্তায় সবসময়ই মেলার ভিড়। তীর্থযাত্রী, পান্ডা, দুই পাশের দোকান থেকে খদ্দের ধরার জন্য হাঁকডাক এবং তার সঙ্গে মোটরসাইকেল, স্কুটার, স্কুটির তীব্র ও তীক্ষ্ণ হর্নের মিলিত শব্দ। এমনিতে ভারতের সবচেয়ে পুরনো শহর বারাণসীর জীবন আবর্তিত হয় মূলত বাবা বিশ্বনাথের মন্দির, গঙ্গা, রাশি রাশি পর্যটক ও বেনারসি শাড়িকে কেন্দ্র করে। তার সঙ্গে অসংখ্য হোটেল, ঠান্ডাই, লস্যি, চাট সহ হরেক রকমের খাদ্য-পানীয় তো আছেই। সেই সঙ্গে আছে অসংখ্য রিক্সা, গাড়ি, মোটরসাইকেল এবং খুব সরু সরু বিখ্যাত সব গলি। এককথায়, নিজের রূপ, রস, গন্ধ ও শব্দ নিয়ে বারাণসী এক জমজমাট শহর।
আর যেহেতু বারাণসী এখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনকেন্দ্র, তাই এই শহরের আলাদা রাজনৈতিক গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। প্রচারের শেষবেলায় নরেন্দ্র মোদী দিনতিনেক মাটি আঁকড়ে পড়েছিলেন এখানে। সেই সঙ্গে ছিলেন সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কংগ্রেসের নেতা-নেত্রী রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। সেই বারাণসী ও তার আশপাশের এলাকার ৫৪টি বিধানসভা আসনে সোমবার ভোট। এই সব এলাকার মধ্যে আছে গাজীপুর, আজমগড়, জৌনপুর, চান্দৌলি, মির্জাপুর, ভাদোই, শোনভদ্র। এটাই উত্তরপ্রদেশের শেষ পর্বের ভোট। আগামী ১০ মার্চ এই ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হবে।
শেষপর্বে এসে বিজেপি এই এলাকাগুলোয় ভালো ফল করার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে। কারণ, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে যে তাদের ফল গতবারের মতো হবে না, তা বিজেপি নেতারাই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় স্বীকার করে নিচ্ছেন। উত্তরপ্রদেশ ঘুরে নির্বাচনী সফরে আমাদেরও মনে হয়েছে, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে জাঠ কৃষকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এবার বিজেপি-র কাছ থেকে সরে গিয়ে সমাজবাদী পার্টি ও তাদের জোটসঙ্গী রাষ্ট্রীয় লোকদলের দিকে চলে গেছে।
তাই বিজেপি-র ভালো ফল করে ক্ষমতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে বড় ভরসা হলো পূর্ব উত্তরপ্রদেশের আসনগুলি। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্র ও তার আশপাশের এলাকায় ফল যদি খারাপ হয়, তাহলে শুধু যে বিজেপি-র মুখ পুড়বে তাই নয় ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন নিয়েও অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে। তাই বিজেপি চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি। প্রধানমন্ত্রীও বারাণসীতে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে দলকে এখানে জয় এনে দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
আর শেষ পর্বের ভোট যেখানে হচ্ছে, তা একসময় মায়াবতীর এলাকা ছিল। এবারের ভোটে মায়াবতী অনেকটাই স্তিমিত। তবে তিনিও শেষ পর্বে তার একদা শক্তির জায়গায় ভালো ফল করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।
মোদী ও যোগী
উত্তরপ্রদেশের অন্য এলাকার সঙ্গে বারাণসী ও তার আশপাশের এলাকার আরেকটা ফারাক আছে। মথুরা, অযোধ্যা, লখনউ থেকে শুরু করে একটা বিস্তীর্ণ এলাকায় বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-র আসল মুখ হলেন যোগী, মোদী নন। হিন্দুত্বের মুখ হিসাবে যোগী এসব জায়গায় মোদীকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন। বিজেপি-র কর্মী, সমর্থকদের কাছে আদিত্যনাথের আকর্ষণ আলাদা। মথুরা, অযোধ্যা, লখনউ সহ উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় বিজেপি-র কর্মী ও ভোটদাতার সঙ্গে কথা বলে এটাই মনে হয়েছে।
কিন্তু এই অবস্থানটা আবার সম্পূর্ণভাবে বদলে যাচ্ছে বারাণসীতে এসে। এখানেই মোদীই একমাত্র মুখ। তার ধারেকাছে, আশেপাশে আর কেউ নেই। মোদীকে সমর্থন এবং মোদীর বিরোধিতার মধ্যেই বারাণসীতে ঘুরছে রাজনৈতিক চক্র। মোদীকে কেউ সমর্থন করতে পারেন, নাও করতে পারেন, কিন্তু কেউ উপেক্ষা করতে পারবেন না। যেভাবে বিশাল একটা হেরিটেজ অংশকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে, সেখানে অসংখ্য মন্দির ভেঙে দিয়ে, বাবা বিশ্বনাথ মন্দিরের করিডোর তৈরি হয়েছে, অন্য কেউ হলে, তার বিরুদ্ধে হাজারটা প্রশ্ন উঠত। চিরতরে হিন্দু-বিরোধী, হেরিটেজ-বিরোধীর তকমা গায়ে বসে যেত। কিন্তু এই কাণ্ডের পরেও মোদীর বিরুদ্ধে বারাণসীর মানুষের কোনো অভিযোগ নেই। জিজ্ঞাসা করলেই জবাব মিলেছে, মোদী তো ঠিক কাজই করেছেন, বিশ্বনাথ দর্শন করার জন্যই গঙ্গা এখানে উত্তরবাহিনী, গঙ্গার সেই বিশ্বনাথ-দর্শনের ব্যবস্থা মোদী করে দিয়েছেন।
গঙ্গা থেকে করিডোর দিয়ে একেবারে অন্য প্রান্তে পৌঁছলেই দেখা যাবে, সেখানে রয়েছে জ্ঞানবাপী মসজিদ। পাঁচিল ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। যে মন্দির-মসজিদ বিতর্ক দীর্ঘদিনের। আরএসএস এবং বিজেপি অযোধ্যা ছাড়াও মথুরা ও বারাণসীতে মসজিদ সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে।
মন্দির-মসজিদ বিতর্কের তিন শহর
মথুরা, অযোধ্যা এবং বারাণসী হলো মন্দির-মসজিদ বিতর্কের তিন শহর। বিজেপি-র প্রচারে বারবার উঠে এসেছে এই মন্দির-মসজিদ বিতর্ক। বারাণসী মন্দিরের নতুন করিডোর, অযোধ্যায় বিশাল রামমন্দির নির্মাণের কথা। বিরোধীদের কাছে, এটা হলো বিজেপি-র বিভাজনের অঙ্ক। এই বিভাজন, মেরুকরণ যেত বেশি হবে, ততই বিজেপি সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে।
এই বিভাজন এবার উত্তরপ্রদেশের ভোটে কতটা হয়েছে? এর জবাব হলো, বিভাজন ও মেরুকরণ হয়েছে। তার সুবিধা বিজেপি ও সমাজবাদী পার্টি দুই দলই পাচ্ছে। যেমন, হিন্দু উচ্চবর্ণ অর্থাৎ, ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বানিয়াদের সিংহভাগ ভোট বিজেপি পেতে পারে। সমাজবাদী পার্টি যাদব ও মুসলিম ভোটের সিংহভাগ পেতে পারে। কিন্তু এরপরের যে বিভাজন, বিজেপি যেটা চেয়েছিল, সেটা হয়েছে কি? যাদব বাদে অন্য অনগ্রসর ভোটের একটা অংশ সমাজবাদী পার্টি পেতে পারে। তেমনই দলিত ভোটের সামান্য একটা অংশও তাদের কাছে আসতে পারে। জাঠ ভোটের একটা অংশও তারা পেতে পারে। সেজন্যই উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টির আসন অনেকাংশে বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিন যে ৫৪টি আসনে ভোট হচ্ছে, সেখানে বেলা একটা পর্যন্ত ভোটের হার ৩৫ শতাংশের সামান্য বেশি। এটাকে খুব বেশি ভোটের হার বলা যাবে না। দিনশেষে ভোটের হার সম্ভবত ৬০ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করবে। এর একটা ব্যাখ্যা হলো, প্রতিটি দলের কমিটেড ভোটাররা ভোট দিয়েছেন বেশি করে।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর উপস্থিতি
কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী এবার উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের হাল ধরেছেন। তারপর দুইটি অভিনব কাজ করেছেন প্রিয়াঙ্কা। প্রথমটি হলো ঢালাও নারী প্রার্থী দিয়েছেন। তাদের মধ্যে একেবারে সাধারণ এতদিন ধরে রাজনীতির আঙিনায় পা না রাখা নারীরা আছেন, আবার উন্নাওয়ের ধর্ষিতার মা, আশা কর্মী, এনআরসি নিয়ে আন্দোলন করা লড়াকু নারীদেরও প্রার্থী করেছেন তিনি।
দ্বিতীয় অভিনব কাজ হলো, প্রচারে নেমে কংগ্রেসের এই দুরবস্থার দায় সরাসরি ভোটদাতাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভোটদাতারাই কখনো ধর্মের নামে, কখনো জাতপাতের কারণে কংগ্রেসের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এবং অন্য দলকে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু তাদের আশাপূরণ হয়নি। বরং একটা ভয়ংকর সময় ডেকে এনেছেন তারা। এভাবে ভোটদাতাদের সরাসরি দায়ী করাটা ব্যতিক্রমী।
কিন্তু সেই কাজটা করে প্রিয়াঙ্কা সামান্য হলেও আলোড়ন তুলেছেন। ভাই রাহুলের মতো মাঝেমধ্যে রাজনীতি থেকে হারিয়ে না গেলে এবং উত্তরপ্রদেশে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে পারলে ভবিষ্যতে দলকে উপরে টেনে তোলার কাজটা করতেই পারেন প্রিয়াঙ্কা।
লখনউয়ের মসনদে কে?
যোগী আদিত্যনাথ নাকি অখিলেশ যাদব, লখনউয়ের মসনদে শেষপর্যন্ত কে বসবেন, তা জানা যাবে আগামী ১০ মার্চ। রাজনীতি এমনই একটা বিষয়, যেখানে আগে থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করতে নেই। বহুবার বহু হিসাব উল্টে দিয়েছেন রাজনীতির কুশীলবরা। তাই কোনো ভবিষ্যদ্বাণী না করে এটুকু বলা যায়, বিজেপি গতবার যে তিনশর বেশি আসন নিয়ে জিতে এসেছিল, এবার সেই সংখ্যা সম্ভবত কমবে। অখিলেশের আসনসংখ্যা সম্ভবত বাড়বে। কিন্তু এই কমা-বাড়া শেষপর্যন্ত কী চেহারা নেবে, তা ১০ মার্চই স্পষ্ট হবে।