যেখানে নির্বাচন কম, ‘সমঝোতা’ বেশি
২৪ মার্চ ২০২৩এছাড়া নির্বাচন না দিয়ে নানা অজুহাতে কমিটির মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়ার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ আবার প্রতিপক্ষকে চাপে রেখে বা ক্ষমতা ব্যবহার করে ভোটের মাঠ থেকে বিদায় করার নজিরও আছে৷
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সর্বশেষ নির্বাচনকে ক্ষমতার জোরে প্রভাবিত করা হয়েছে বলে মনে করেন আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ৷ তার কথা, ‘‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার মনসুরুল হককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়৷ তারপর পছন্দের নির্বাচন কমিশনার বানিয়ে পরিস্থিতি নিজেদের অনুকুলে নিয়েছেন আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীরা৷’’
এই নির্বাচন নিয়ে আগের দিন রাতে এবং নির্বাচনের দিন মারপিট ও হাঙ্গামার ঘটনাও ঘটেছে৷ পুলিশ সাংবাদিক ও আইনজীবীদের মারপিট করেছে৷ সেই পরিস্থিতিতে আওয়ামী প্যানেলের সবাই জয়ী হয়েছেন৷
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘এটা একটা ন্যক্কারজনক ঘটনা৷ সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনা এই প্রথম৷ পেশাজীবী সংগঠনগুলোর যে কয়টিতে এখনো ঠিকমতো ভোট হতো তার একটি ছিল সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি৷ তা-ও শেষ হয়ে গেল৷’’
তিনি মনে করেন, ‘‘জেলা বারগুলোর অনেক জায়গায়ই এখন নির্বাচন হয় না৷ কমিটির মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়া হয়৷ আর যেখানে হয় সেখানেও প্রভাব বিস্তার করা হয়৷’’
সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে যা ঘটেছে, ঢাকা বারেও সেরকম ঘটনা ঘটেনি৷ সেখানে নির্বাচন হয়েছে৷ সুপ্রিম কোর্টে নিকৃষ্টতম উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে৷ ভোট বুথে পুলিশ ঢুকে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে৷’’
তার কথা, ‘‘এখনো অনেক বারে নির্বাচন হয়৷ কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট বারের এই ঘটনার পর অন্যান্য বারেও এর প্রভাব পড়বে৷’’
মনজিল মোরসেদ মনে করেন, ‘‘এমন পরিস্থিতিই এখন সবখানে৷ বাণিজ্যিক সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্টার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচন, কোথায় না এই পরিস্থিতি হচ্ছে! এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচনে বিএনপিপন্থিরা অংশই নেইনি৷ বাংলাদেশে বাণিজ্য সংগঠনগুলোর অধিকাংশই এখন সরাসরি নির্বাচনের পরিবর্তে সমঝোতার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট এবং সাধারণ সম্পাদক মনোনয়নের দিকে চলে গেছে৷ তবে অন্যান্য পদ বা ফেডারেশনের পরিচালক পদে কখনো কখনো নির্বাচন হয়৷’’
বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রি (এফবিসিসিআই)-র বর্তমান সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন ২০২২ সালে একক প্রার্থী ছিলেন৷ তাকে সমঝোতার ভিত্তিতে একক প্রার্থী করা হয়৷ তার আগের সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনের বিপরীতে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন না৷
তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-র পরিচালনা পর্যদের নির্বাচন প্রায় ১০ বছর ধরে অনিয়মিত৷ ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কোনো নির্বাচন হয়নি৷ ২০১৯ সালে রুবানা হক নির্বাচনের মাধ্যমে সভাপতি হন৷ এরপর ২০২২ সালে আবার সমঝোতার মাধ্যমে কমিটি গঠন করার উদ্যোগ নেয়া হলেও সদস্যদের দাবির মুখে নির্বাচন হয়৷ সেখানেও প্রতিপক্ষ ছিল নামে মাত্র৷
প্রায় ১১ বছর ধরে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-র সভাপতি পদে আছেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাংসদ এ কে এম সেলিম ওসমান৷ ২০১২ সালের পর থেকে ব্যবসায়ীদের এই সংগঠনটির পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন হচ্ছে না৷
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)-এ ২০১৪ সাল থেকে ভোটাভুটি হয় না৷ সমঝোতার মাধ্যমেই কয়েক মেয়াদে সভাপতি পদে আছেন আলমগীর শামসুল আলামিন৷
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)-রও একই অবস্থা৷ মোহাম্মদ আলী খোকন কয়েক মেয়াদ ধরেই সভাপতি পদে আছেন৷
২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ই-ক্যাব নামে ই-কমার্সের বাণিজ্য সংগঠনটিতে এর আগে ৩টি পরিষদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল৷ এখন সভাপতি শমী কায়সার এবং সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ তমাল৷ তারা দুইজন দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত৷
এ নিয়ে বাণিজ্য সংগঠনের নেতা বা ব্যবসায়ীরা কথা বলতে চান না৷ কথা বলতে চান না ব্যবসায়ীরাও৷ তবে এফবিসিআিইর সাবেক সহ-সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘‘শীর্ষ ট্রেড বডিগুলো থেকে ভোট এখন উঠেই গেছে৷ শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয় সমঝোতার মাধ্যমে৷ তারা আশীর্বাদপুষ্ট থাকেন৷ এর ফলে ভোটারদের ভোট দিতে হয় না৷ তাদের মন খারাপ হয়৷ ব্যবসায়ীরা নেতা পছন্দ করতে পারেন না৷ আবার যারা ব্যবসায়ী নেতা আছেন, তারাও নির্বাচনে দাঁড়াতে না পেরে মন খারাপ করেন৷’’ তার কথা, ‘‘আমরা স্বচ্ছতার কথা বলি, নির্বাচন ও গণতন্ত্রের কথা বলি৷ তাই এইভাবে সমঝোতা হওয়া দুঃখজনক৷’’
ভোট কেন হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমি যে ডালে থাকি সেই ডাল তো কাটতে পারি না৷’’
বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ী সংগঠনে কথা হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘যেটুকু বলেছি, সেটুকুই থাক৷ আর কথা বলতে চাই না৷’’
কিন্তু বাণিজ্য সংগঠন আইন ২০২২-এর ১৬ ধারায় নিয়মিত নির্বাচনের কথা বলা আছে৷ আর আইনের ব্যত্যয় ঘটলে শাস্তিরও বিধান আছে৷ তবে ১৪ ধারায় বলা হয়েছে যদি দৈব-দুর্বিপাক বা সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে নাই এমন কোনো কারণ থাকে তাহলে সংগঠনের আবেদনে মেয়াদের পরও সর্বোচ্চ আরো ছয় মাস নির্বাচনের জন্য সময় পাওয়া যাবে৷ তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন অনুবিভাগের মহাপরিচালক যে সময় দেবেন, তার মধ্যে নির্বাচন করতে ব্যর্থ হলে সরকার প্রশাসক নিয়োগ করতে পারবে৷
এই পরিস্থিতিতে ট্রেড বডিগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন অনুবিভাগের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান লিখিতভাবে জানান, ‘‘বাণিজ্য সংগঠন আইন ২০২২ এবং বিধিমালা ১৯৯৪ অনুযায়ী মূলত আনুষ্ঠানিকভাবে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনের সুযোগ নেই৷’’ তিনি জানান, তবে বিধিমালায় অপ্রতিদ্বন্দ্বিত নির্বাচনের বিষয়ে বলা আছে-
(১) বিধি ১৫(১)(জ)-এর অধীনে প্রার্থীতা প্রত্যাহারের পর যদি দেখা যায় যে, বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা নির্বাচনযোগ্য সদস্যসংখ্যার সমান বা তার চেয়ে কম, তাহলে ভোট গ্রহণের প্রয়োজন হবে না এবং এই প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন মর্মে ঘোষণা করা হবে৷
(২) বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা নির্বাচনযোগ্য সদস্যসংখ্যা অপেক্ষা কম হলে ওই ভোটার তালিকার ভিত্তিতে ওই নির্বাচন তারিখের পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে বাকি সদস্য পদের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে৷ এবং সংগঠনের নোটিশ বোর্ডে নতুন নির্বাচন তফিসিল ঘোষণা করতে হবে এবং এক্ষেত্রে বিধি ১৫(১)-এ উল্লিখিত সময়সীমা প্রযোজ্য হবে না৷
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ মনে করেন, ‘‘পেশাজীবী ও ট্রেড বডিগুলোর ওপর দেশের যে রাজনৈতিক অবস্থা তার প্রভাব পড়েছে৷ এর ফলে এইসব জায়গা থেকেও নির্বাচন হারিয়ে যাচ্ছে৷ কেউ যদি সমঝোতার বাইরে গিয়ে নির্বাচন করতে চান, তাকে হয়রানির শিকার হতে হয়৷’’
আর ব্যারিস্টার ওমর ফারুক মনে করেন, ‘‘জাতীয় রাজনীতিতে গণতন্ত্রের চর্চা ফিরিয়ে না আনলে কোথাও গণতন্ত্রের চর্চা থাকবে না৷’’