ম্রিয়মান তাজমহলের ঐতিহাসিক সৌন্দর্য
৪ আগস্ট ২০১৮সপ্তদশ শতকে আগ্রায় যমুনার তীরে মোঘল সম্রাট শাহজাহানের নির্মিত বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম এই তাজমহল৷ কিন্তু আজ তাজমহলের সৌন্দর্য ম্লান৷ কারণ শুধুমাত্র উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব৷ কিন্তু সেই দায়িত্ব কার? সেই নিয়ে চলেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে চাপানউতোর৷ একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে৷
সুপ্রিম কোর্ট এই ধরনের প্রবণতার জন্য তিরস্কার করেছে উত্তর প্রদেশ সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে৷ জারি করেছে একগুচ্ছ নির্দেশ৷ তাতে বলা হয়েছে, তাজমহলের আসল সৌন্দর্য পুনরুদ্ধার করতে প্রথমেই দরকার তাজমহলের চারপাশটা দূষণমুক্ত রাখা৷ তাজমহলের চারপাশে এখনো রয়েছে দূষণ ছড়ানো ১১৬৭টি কলকারখানা৷ তাজমহলের শ্বেত পাথরের দেয়ালে আজ হলুদের ছাপ৷ এই দূরবস্থার জন্য ইউনেস্কো যদি তাজমহলের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ট্যাগ তুলে নেয়, তাহলে সেটা হবে ভারতের পক্ষে খুবই লজ্জার৷
শীর্ষ আদালত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগের মহা অধিকর্তা, আগ্রার ডিভিশনাল কমিশনার এবং পরিবেশ দপ্তরের যুগ্ম সচিবের উপর তাজমহলের রক্ষণাবেক্ষণের সামগ্রিক দায়িত্বভার ন্যস্ত করেছে৷ ভবিষ্যতে তাজমহল সংক্রান্ত হলফনামা আদালতে পেশ করতে হলে ঐ তিনজনের মধ্যে যে-কোনো একজন করতে পারবে৷ তাজমহলের চারিদিকের অঞ্চলের দূষণ রোধের দায়িত্ব নিতে হবে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব এবং আগ্রা ডিভিশনের কমিশনারকে৷ তাজের আশপাশের ১০৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা রাখতে হবে সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত৷ তা না হলে তাজমহলকে বাঁচানো সম্ভব হবে না৷ তাজমহলের মৌলিক স্থাপত্যকলা অক্ষুণ্ণ রাখতে নিয়োগ করতে হবে বিশেষজ্ঞদের৷ তার জন্য অর্থবরাদ্দের দায়িত্ব সরকারের৷ এর পাশাপাশি তাজমহলের ভেতরের চত্বরে যে মসজিত আছে, সেখানে আগ্রার স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়া বাইরের কাউকে শুক্রবারের নামাজ পড়ে দেওয়া হবে না, শীর্ষ আদাতের রায়ে এমনটাই বলা হয়েছে৷
গত ২৪শে জানুয়ারি আগ্রার অতিরিক্ত জেলা শাসকের জারি করা এক নির্দেশিকায় বলা হয়, বহিরাগতদের অবাধ প্রবেশ তাজমহলের সুরক্ষা বিঘ্নিত করতে পারে৷ এই নির্দেশিকার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানিয়েছিলেন এক ব্যক্তি৷ সেই মামলার শুনানিতে এই রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট৷ এমনিতে প্রতি শুক্রবার তাজমহল বন্ধ থাকে৷ শুধু নামাজ পড়ার জন্য খোলা রাখা হয়৷ সেখানে নামাজের জন্য আগ্রায় থাকেন এমন মুসলমানদের বৈধ পরিচয়পত্র দেখালে তবেই ঢুকতে দেওয়া হবে৷ এটা শুধু দূষণের জন্য নয়, নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত৷
এক অভিজ্ঞ সংরক্ষণ স্থপতি নবীন পিপলানি মনে করেন, তাজমহলের সংস্কারের কাজে আরো বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা দরকার৷ দরকার এ জন্য আরও অর্থ বরাদ্দ করার৷ কিন্তু এই ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধের গরিমা পুনরুদ্ধারে সরকারের ঢিলেমি চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে৷ অর্থ সংগ্রহের জন্য দরকার হলে বেসরকারি পর্যটন শিল্প সংস্থাগুলির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে৷ নজর দিতে হবে তাজমহলের পেছনের দিকে বহমান যমুনা নদীর সংস্কার করা৷ বর্তমানে যমুনা প্লাস্টিকসহ আবর্জনায় দূষিত৷
যমুনা দূষণ তাজমহলের কতটা ক্ষতি করতে পারে এবং সেটা ঠেকানোর উপায় কী জানতে চাওয়া হলে বিজ্ঞান ও পরিবেশ সেন্টারের গবেষক সুস্মিতা রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নদীর জল দূষণ রোধে আমরা অনেকগুলি নীতি এবং প্রযুক্তি স্থির করেছি৷ নদীতে জলের মাত্রা যত কম থাকবে, দূষণের মাত্রা তত বাড়বে৷ সেটার জন্য নদীর জলকে আরও ডাইলিউট বা তরল রাখতে হবে৷ দ্বিতীয়ত, জলকে রি-সাইকেল করতে হবে যাতে ঐ জলকে আবার ব্যবহার করা যায়৷ নদীতে প্লাস্টিক আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে হবে৷ তৃতীয়ত, নালি-নর্দমার নোংরা জলও যাতে নদীতে গিয়ে না পড়ে, সেটাও দেখতে হবে৷ প্লাস্টিক আবর্জনা নদীতে পড়ার আগে সেটা সেগ্রিগেড করা বা আলাদা করা জরুরি৷''
প্রশ্ন হলো, এটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব কার? পরিবেশ গবেষক সুস্মিতা রায় জানান, ‘‘প্রাথমিক দায়িত্ব মিউনিসিপালিটির এবং ন্যাশনাল মিশন অফ ক্লিন ওয়াটার-এর৷ যমুনা ক্লিনিং এবং গঙ্গা ওয়াটার ক্লিনিং কর্মসূচির অধীনে পড়ে এটা৷ সোজা কথা, কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়কেই হাত মেলাতে হবে, সঙ্গে থাকবে পুরসভা৷''
এত গেল এক দিক৷ অন্যদিকে তাজমহলের মালিকানাসত্ত্ব দাবি করেছে উত্তর প্রদেশের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড৷ সম্রাট শাহজাহান স্বয়ং নাকি তাজমহলের ওয়াকফনামা দিয়ে গেছেন সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে৷ কাজেই তাজমহল সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগের সম্পত্তি নয়৷ দীর্ঘদিন ধরে এই নিয়ে মামলা ঝুলে থাকায় মামলাকারীরা এই দাবি নিয়ে যান শীর্ষ আদালতে৷ আদালত দাবির প্রমাণ দেবার জন্য বাদশা শাহজাহানের স্বাক্ষরিত সব নথিপত্র পেশ করতে বলে উত্তর প্রদেশ ওয়াকফ বোর্ডকে৷ শাহজাহান মারা যান ১৬৬৬ সালে৷ মৃত্যুর প্রায় ১৮ বছর আগে তিনি তাজমহল তৈরি করেছিলেন, পত্নী মমতাজের স্মৃতিরক্ষায়৷ তাই শীর্ষ আদালতের কথায়, এই ধরনের দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা নেই৷ কারণ শাহজাহান তখন ছেলে ঔরঙ্গজেবের হাতে আগ্রাফোর্টে গৃহবন্দি৷ তাহলে কীভাবে তিনি সই করতে পারেন ঐ ওয়ারিশনামায়? তাই এই ধরনের মামলা আদালতের সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই নয়, জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷
আপনার কোনো মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷