মৌলিক অধিকারও নেই যাদের
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯২০১১ সালে একদিন রাতে বাসায় ফিরছি৷ মগবাজার সিগনালে রিকশা দাঁড়াতেই এক রাজপুত্রসম শিশু চিপস নিয়ে এলো৷ আমি সেই শিশুর চটপটে চোখ আর হাসিমাখা মুখ দেখেই পাঁচ প্যাকেট চিপস কিনে নিলাম৷ সিগনালে অনেকক্ষণ থাকার ফলে গল্পও করলাম৷ তার নাম রাব্বি, কামরাঙ্গিচরে থাকে৷ মা এখানে একটা হোটেলে মসলা বাটার কাজ করে৷ তাই সে বাইরে চিপস বিক্রি করে সময় কাটায়৷ বাড়তি ১০টা টাকা হাতে দিলাম, ফিরিয়ে দিলো৷ গুণে গুণে চিপসের ভাংতি ফেরত দিয়ে বললো, বাড়তি টাকা নেব কেন৷ রাব্বির গুণমুগ্ধ হয়ে গেলাম৷ প্রায়ই দেখা হয়, চিপস কিনি, কথা হয়৷ নাগরিক ব্লগের উদ্যোগে আমরা প্রতিবছর পথশিশুদের ঈদের পোশাক দিতাম৷ সেই সময় আলাদা করে রাব্বির জন্যও জামা সরিয়ে রাখতাম৷ দেখা হলে ঈদের জামা দিতাম৷ ওর মা জানিয়েছিলেন, শিগগির স্কুলে দেবেন রাব্বিকে৷
এরপর আবাস ও কর্মস্থল বদলের কারণে মগবাজার দিয়ে যাওয়া হয় না৷ রাব্বির সঙ্গেও যোগাযোগ কমতে থাকলো৷ ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাতিরঝিলে আমার সিএনজি অটোরিকশা এসে জ্যামে দাঁড়িয়েছে৷ এক গাদা ছেলে-মেয়ে ঘিরে ধরেছে৷ কেউ বাদাম বিক্রি করতে চায়, কেউ ভিক্ষা চায়, কেউ কিছু খেতে চায়৷ একদম পেছনের একটি ছেলের দিকে তাকিয়ে ‘রাব্বি' বলে চিৎকার দিয়ে উঠলাম৷ সবাই তাকে ঠেলে সামনে দিয়ে বললো, ‘‘রাব্বিরে আপনে চিনেন?'' রাব্বি আমার বিস্মিত চোখের দিকে তাকিয়ে ঠেলে ছুটে বের হয়ে গেল৷ আর শুধু বলে গেল, ‘‘আমার নাম রাব্বি না৷''
ও চলে যেতেই আরেক ছেলে বললো, ‘‘ঐ রাব্বি, এখন নিশা করে৷'' এই তথ্য দিয়ে আমাকে সমৃদ্ধ করে ১০টি টাকা চাইলো ছেলেটি৷ জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘রাব্বির মা কোথায়৷'' সেই ছেলেটিই জানালো, মা আরেকটি বিয়ে করে চলে গেছে৷ আগে কামরাঙ্গিচর বস্তিতে থাকলেও এখন মগবাজার ফ্লাইওভারের নীচে থাকে রাব্বি৷ ভিক্ষা করে, নেশা করে৷
চোখের সামনে নক্ষত্রপতন দেখলাম৷ ৫ বছর আগে যে ছেলের মূল্যবোধ আমাকে বিমোহিত করেছিল৷ পাঁচবছর পর সেই ছেলের আমূল বদলে যাওয়া ততটাই বিস্মিত করেছে৷
রাব্বির মতো প্রতিনিয়ত অসংখ্য শিশু এভাবে নেশার আড়ালে হারিয়ে যায় শুধুমাত্র খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা মৌলিক চাহিদা পূরণের অভাবে৷
২০১৫ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহ্যান্সমেন্ট প্রোগাম' (সিপ) ‘পথশিশুদের অমানবিক জীবন ও বিভিন্ন সমস্যা' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থের অভাবে পথশিশুদের ৭৫ ভাগ ডাক্তারের কাছে যেতে পারে না৷ অসুস্থ হলে তাদের প্রায় ৫৪ ভাগের দেখাশুনার জন্য কেউ নেই৷ পথশিশুদের প্রায় ৪০ ভাগ প্রতিদিন গোসল করতে পারে না৷ আর ৩৫ ভাগ শিশু খোলা জায়গায় পায়খানা করে৷ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠে তারা৷
এরপরের বছর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ঢাকা আহছানিয়া মিশন আয়োজিত এক সেমিনারে উপস্থাপিত প্রবন্ধে বলা হয়, সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু আছে সাড়ে ১১ লাখ৷ এর মধ্যে সাড়ে পাঁচ লাখই মাদকাসক্ত৷
তবে এসব জরিপের সঙ্গে যে গবেষণাটি তারা যুক্ত করেনি, সেটি হচ্ছে, এই শিশুদের কারোরই অভিবাবক নেই৷ এদের জন্মদাতা পিতা-মাতা রয়েছে৷ কিন্তু আগলে রাখার মতো অভিবাবক তাদের নেই৷
অভিবাববক, স্নেহ ও খুব সাধারণ কিছু চাহিদার অভাবই তাদের পথশিশু করেছে৷ বাংলাদেশে নাকি ১১ লাখ পথশিশু রয়েছে, যার সিংহভাগের আবাস ঢাকা শহরে৷
কতদিন মাঝরাতে বাড়ি ফেরার পথে মাঝরাস্তায় আইল্যান্ডের ওপর ঘুমিয়ে থাকা নিস্পাপ শিশু-মুখ দেখে ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরেছি৷ ব্যক্তি উদ্যোগে হয়ত একজন-দুজন শিশুকে পুনর্বাসন করা সম্ভব আমাদের পক্ষে৷ অনেকেই সেটি করে থাকেন৷ কিন্তু এই ১০ লাখ শিশুকে সুস্থ স্বাভাবিক ও ন্যূনতম চাহিদা পূরণ হওয়া জীবন দিতে হলে রাষ্ট্রীয় পৃ্ষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগের বিকল্প নেই৷ দিনশেষে আমরা সবাই চাই, রাব্বিরা যেন নেশা না করে৷ মায়ের স্নেহের ছায়ায় বড় হওয়ার অধিকার যেন ওর থেকে কেউ কেড়ে না নেয়৷
আপনিও কি মনে করেন, পথশিশুদের জন্য তেমন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নেই? লিখুন নীচের ঘরে৷