মোদী সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে কি তিস্তা চুক্তি হবে?
২৮ মে ২০১৯৯০-এর দশক থেকে ভারত-বাংলাদেশের সুসম্পর্কের পথে কাঁটার মতো গেঁথে আছে তিস্তার জলবণ্টন চুক্তি৷ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে যতবারই বৈঠকে পর্যালোচনা হয়েছে, অনিবার্যভাবে উঠে এসেছে এই চুক্তির প্রশ্ন৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের অনড় অবস্থানের কারণে এতদিন এই চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়নি৷ এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে এতদিন বিজেপির পায়ের নীচে মাটি ছিলনা, তাই কেন্দ্রীয় সরকার জোরাজুরি করতে পারেনি৷
দ্বিতীয়ত, নদীর জল সংক্রান্ত বিষয় রাজ্য সরকারের সাংবিধানিক এখতিয়ারে পড়ে৷ হালের নির্বাচনি ফলাফল কিন্তু রাজ্যের রাজনৈতিক চালচিত্রটাই পালটে দিয়েছে৷ রাজ্যের ৪২টি সংসদীয় আসনের মধ্যে আগে যেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিপত্য ছিল, এখন তারা মাত্র ২২টি আসনে টিকে আছে৷ পাশাপাশি মাত্র দুটি আসন থেকে ১৮টি আসন পেয়ে বিজেপির মনোবল বেড়েছে৷ ফলে রাজনৈতিকভাবে তৃণমূলের মোকাবিলা করার শক্তি বেড়েছে৷
এদিকে, নির্বাচনে ধরাশায়ী হবার পর তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ক্রমশই লাগামছাড়া হচ্ছে৷ দলত্যাগ করে বিজেপিতে যাচ্ছেন তৃণমূল বিধায়করা৷ ফলে তৃণমূলের এখন ছত্রভঙ্গ অবস্থা৷
রাজ্যের বিজেপির সাংগঠনিক নেতা দিল্লিতে বিজেপির নব নির্বাচিত সাংসদের সম্প্রতি বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে প্রথম ধাপ পার করেছে দল৷ এরপর দ্বিতীয় ধাপে বিধানসভা ভোটে জিতে ২০২১ সালে রাজ্যে সরকার গড়বে বিজেপি৷ মোদী সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে তাই তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের পথ শুধু প্রশস্তই হবে না, ত্বরান্বিত হবে৷
পাশাপাশি, ঢাকাও হাত গুটিয়ে বসে নেই৷ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মোদী দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরতেই তিস্তা চুক্তি রূপায়নে তাগাদা দিতে শুরু করেছে হাসিনা সরকার৷ গত পাঁচ বছর বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক দৃঢ় করতে চেষ্টার কসুর করেননি মোদী৷ মনে করা হচ্ছে, তিস্তা ইস্যুটিকে এবার অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি দিল্লি-ঢাকা সুসম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন৷ তিস্তার জলের ভাগাভাগি নিয়ে চুক্তির বিষয়ে একটা ঘরোয়া রাজনৈতিক ঐকমত্য গত পাঁচ বছরে তৈরি হয়েই ছিল৷ এবার সেটার বাস্তবায়ন হবে বলে মনে করছেন উভয় দেশের কূটনীতিকরা৷
বিদেশ সফর কর্মসূচির জন্য মোদীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা যোগ দিতে পারবেন না৷ তবে ঢাকা ফেরার পথে ৮ জুন দিল্লি এসে শেখ হাসিনা মোদীর সঙ্গে বৈঠক করবেন এবং সেখানে তিনি মোদীকে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন৷ বলবেন দ্বিপাক্ষিক স্বার্থে কোনোমতেই এটা আর ফেলে রাখা ঠিক হবে না৷
এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক ইমন কল্যাণ লাহিড়ি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এরমধ্যে দুটো কথা আছে৷ প্রাথমিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপট, যেটা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ দ্বিতীয়ত, ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্ন, যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এজন্য শেখ হাসিনার হাত শক্ত করতেই হবে দিল্লিকে৷ কেননা, বাংলাদেশের মাটিতে যেভাবে শ্লোগান উঠছে, শেখ হাসিনা তুই ভারত যা, দেশ চালাবে খালেদা, ভারতে গণতন্ত্রের যে একটা পদ্ধতি আছে বা সামাজিক প্রেক্ষাপট আছে, তারজন্য এটা ভালো নয়৷ সুতরাং শেখ হাসিনার হাত শক্ত করা এবং লিবারেল পয়েন্ট বাংলাদেশে একমাত্র শেখ হাসিনার মধ্য দিয়েই উঠে আসতে পারে৷ হাসিনার যে ভাবমূর্তি বা তাঁর নেতৃত্বের মধ্য দিয়েই উঠতে পারে৷''
অধ্যাপক লাহিড়ি বলেন, ‘‘ভারতে এখন যেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো তিস্তা চুক্তির দ্রুত সমাধান এবং তা স্বাক্ষর করা৷ দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা আটকে রেখেছেন৷ যদিও কেন্দ্রীয় সরকার বারবার এই চুক্তি স্বাক্ষরের পক্ষে ছিলেন৷ বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু এখনো অপেক্ষা করে আছে, আশা করে বসে আছে এই চুক্তির উপরে৷ এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ সরকার দেশের মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হবে যে ভারত একটি প্রকৃত বন্ধু রাষ্ট্র৷ সুতরাং এশিয়ায় শান্তি প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে এবং ভূমিগত বাস্তবতার ক্ষেত্রে আমরা যেটা দেখছি, এই বছরের নির্বাচনে যেভাবে বিজেপির জয় হয়েছে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যেভাবে একটা পরিবর্তনের ডাক দিয়েছে, তাতে ২০২১-এর মধ্যে রাজ্যে বর্তমানে যে সরকার আছে, তা থাকবে না৷ যদি না থাকে, তাহলে কিন্তু আমার মনে হয়, তিস্তা চুক্তি দ্রুত স্বাক্ষরিত হবে৷ কারণ আঞ্চলিক স্তরে তো একটা সরকার চলতে পারে না৷ আরো একটা কথা, পশ্চিমবঙ্গ একটা সীমান্ত রাজ্য, যার সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সীমানা আছে৷ কাজেই রাজ্য সরকারের দুটো দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত ছিল৷ একটা রাজ্যের আঞ্চলিক বিষয়, অন্যটি বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক মজবুত করা৷ কাজেই আগামী দুই বছর হয়ত দিল্লি ও ঢাকাকে অপেক্ষা করতে হবে৷ তবে মনে হয়, আন্তর্জাতিক চাপে তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি শিগগিরই স্বাক্ষরিত হবে৷''