ইতিহাস গড়লেন মোদী
১৪ মার্চ ২০১৭ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তর প্রদেশ হিন্দি বলয়ের ভরকেন্দ্র৷ জাতীয় রাজনীতির বাতিস্তম্ভ বলা হয়ে থাকে একে, যদিও রাজ্যটির ভোট বিভাজিত হয়ে থাকে কার্যত জাতপাত ও ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে৷ কিন্তু এবারের ভোটে সেই ফর্মুলাটা একেবারেই উল্টে গেল৷ বেড়া ভেঙে উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণ ও বিজেপি বিরোধী মুসলিম সম্প্রদায় একযোগে ভোট দিয়েছে গৈরিক পার্টিকেই৷ বিশেষ করে মুসলিম প্রধান পশ্চিম উত্তর প্রদেশের মজফ্ফরনগর, সামলি, বেরিলি, খলিলাবাদ, মিরাট, মোরাদাবাদ ইত্যাদি এলাকার ২৪টি আসনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ প্রার্থী হেরে গেছেন৷ ভোট আড়াআড়িভাবে ভাগ হয়ে গেছে৷ অনেকে বিস্মিত হয়েছেন, কিন্তু স্বীকার করেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী মোদীর সর্বভারতীয় গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে গেছে অনেক গুণ৷ সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্খার নাড়িটা বুঝে তিনি অর্থনৈতিক বিকাশ এবং জাতীয়তাবাদের পেশিশক্তিকে নির্বাচনি প্রচারে কাজে লাগিয়েছেন এবং তাতে সফল হয়েছেন৷ সব সম্প্রদায়ের ধারণা হয়েছে, রাজ্যের বড় বড় দল যেমন, মুলায়েম সিং-এর পরবর্তিকালে অখিলেশ সিং-এর সমাজবাদী পার্টি, মায়াবতীর দলিত বান্ধব বহুজন সমাজ পার্টির শাসন তো দেখা হলো, এবার বিজেপিকে ভোট দিয়ে দেখা যাক, রাজ্যের বিকাশে কতদূর কী করতে পারে৷ কারণ কেন্দ্রে আছে মোদী সরকার৷ কাজেই রাজ্যের উন্নয়নের একটা ইতিবাচক সংযোজন এটা৷ সময় এসেছে জাতপাত ও ধর্ম-ভিত্তিক রাজনৈতিক পরিচয় পালটাবার. দরকার স্রেফ বিকাশ৷
এরই প্রতিধ্বনী তুলে বিকাশের জোরাল বার্তা দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ বিজেপির সাফল্যের পর গত রবিবার নতুন দিল্লির দলীয় সদর দপ্তরে বক্তব্য রেখে ২০১৪ সালের অচ্ছে দিনের স্লোগান সরিয়ে ২০২২ সালের মধ্যে নব ভারত গড়ার স্বপ্ন দেখা তিনি, বললেন খয়রাতি বা ভরতুকির পরিবর্তে গরিবদের দিতে হবে স্ব-রোজগারের সুযোগ৷ মধ্যবিত্তদের দায়দায়িত্বের বোঝা হাল্কা করতে হবে৷ দেওয়া হবে মহিলাদের স্বশক্তিকরণের সুবিধা৷ এটাই হবে তাঁর নব-ভারতের স্বপ্ন সাকার করার মন্ত্র৷ এটা ২০১৯ সালের নির্বাচনি স্লোগান নয়, এটা আগামী পাঁচ বছরে দলের উদ্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা৷
উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস কোথায় দাঁড়িয়ে? কংগ্রেসের শক্তি রাজ্যে আর ধর্তব্যের মধ্যে নেই৷ শাসকদল সমাজবাদী পার্টির হাত ধরেও মোট ৪০৩টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র সাতটি আসন৷ কংগ্রেস কর্ণধার রাহুল গান্ধীর আমেথি সংসদীয় আসনের আওতায় থাকা আসনগুলিতেও সুবিধা করতে পারেনি৷ দলিত পার্টি বহুজন সমাজ পার্টির (বিএসপি) ভোট ছিল মায়াবতীর হাতে এবারে তাও হাতছাড়া৷ তাই বিএসপির এখন অস্তিত্বের সংকট৷
উত্তর প্রদেশে বিজেপির সাফল্যের কারণ ডয়চে ভেলের কাছে ব্যাখ্যা করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা৷ কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক প্রবীর কুমার দে মনে করেন, ধর্মীয় মৌলবাদ কাজ করেনি৷ গুজরাট দাঙ্গার পর সংসদীয় নির্বাচনে মোদী যেভাবে জয়ী হলেন, তাতে মনে হয় সেটা জনমানসে তেমন দাগ রাখতে পারেনি৷ এখন দেশ চাইছে সংসদীয় ভোটের সময়কার বিকাশের মডেল৷ উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে সেটাই ছিল সাধারম মানুষের প্রত্যাশা৷ ভেবেছে মোদী জমানা একটা স্থিতিশীল উন্নয়নের সুফল এনে দিতে পারবে৷ সেটা কতটা পারবে, সেটা সময়ই বলে দেবে৷ নোট বাতিল ইস্যুতে সাধারণ মানুষের মনে হয়েছে এটা বিকাশের একটা পন্থা৷ প্রথমদিকে কিছুটা সংশয় থাকলেও পরে সেটা কেটে যায়, ডয়চে ভেলেকে বললেন অধ্যাপক প্রবীর দে৷
বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, রাজ্যে ভোটের মুখে পারিবারিক ভাঙনকেই শাসকদল সমাজবাদী পার্টির ভরাডুবির অন্যতম কারণ৷ এতে দলের বিশ্বাসযোগ্যতা মার খেয়েছে৷ বরিষ্ঠ নেতারা যেহেতু ছিল দলের প্রতিষ্ঠাতা মুলায়েম সিং যাদবের পক্ষে সেহেতু অখিলেশ সিং-এর গ্রহণীয়তায় ভাটা পড়ে৷ অখিলেশকে রাজনৈতিকভাবে অপরিণত বলে মনে হয়েছে ভোটারদের৷ মুসলিমদের ভোট ভাগ হবার কারণ হিসেবে ড. চট্টোপাধ্যায় ডয়চে ভেলে বলেন, কেন্দ্রে আছে বিজেপি সরকার৷ রাজ্যে মুসলিমদের আলাদা ভোট ব্যাংক থাকলে তাতে আখেরে লাভের চেয়ে লোকসান হবে বেশি৷ মুসলিমরা আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে৷ বিমুদ্রাকরণ প্রসঙ্গে তিনি মনে করেন, আচমকা নোট বাতিলের ফলে প্রথমদিকে সাধারণ মানুষের কিছুটা সমস্যা হয়েছিল ঠিকই৷ কারণ তাঁদের কাছে নগদ ছিল না৷ পরে বুতে পেরেছে, নোটবন্দির ফলে কালো টাকার ওপর যারা বসে আছে, কর ফাঁকি দিয়ে তাঁদের শায়েস্তা করার এটা মোক্ষম দাওয়াই৷ ফলে ভোটে সেটা ইস্যু হয়নি৷ বরং মোদীর সাহসী পদক্ষেপ প্রশংসিত হয়েছে৷ কর্মসংস্থানের জন্য তরুণ প্রজন্মের আস্থা আছে মোদীর ওপর৷ সেটা কতটা পূরণ হবে তা সময়ই বলবে৷ অন্যদিকে কংগ্রেসে এখন নেতৃত্বের সংকট৷ রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বের ওপর এখন প্রশ্নচিহ্ন৷ গান্ধী পরিবারের বাইরে বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে তোলা দরকার৷ তা না হলে কংগ্রেসে দেখা দিতে পারে ভাঙন৷
প্রেসিডেন্সি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ডক্টর অমল মুখোপাধ্যায় মনে করেন, মোদীর ক্যারিশমাই উত্তর প্রদেশে বিজেপির আশাতীত জয়ের মূল কারণ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, মোদী যেভাবে প্রচার অভিযান চালিয়েছিলেন, তার ফলেই এই মোদী ঝড়ের উত্পত্তি৷ তাতে উড়ে গেছে সব বিরোধিশক্তি৷ এই ঝড় আগামী ভোট পর্যন্ত মোদী ধরে রাখতে পারবে বলে তিনি মনে করেন৷ নোট বাতিল ইস্যু নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে যে জোট বাঁধার চেষ্টা করেছিলেন তা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ৷ কারণ পশ্চিমবঙ্গের বাইরে মমতার দাপট নেই৷ মোদীর জয়ে কি রামমন্দির, বাবরি মসজিদ ইস্যু আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরে ড. মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বললেন, অবশ্যই সেই বিপদটা আছে৷ মৌল হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস মোদীর ওপর এই নিয়ে চাপ বাড়াতে পারে এবং সেটা হবে দেশের পক্ষে ভয়ের কারণ৷