আওয়ামী লীগের এমপিদের মূল্যবোধের অবক্ষয়
১৯ জানুয়ারি ২০১৮চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া এলাকার সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউসুফের অর্থের অভাবে চিকিৎসা হচ্ছিল না৷ প্রায় বিনা চিকিৎসায় তিনি মরতে বসেছিলেন৷ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তার চিকিৎসা শুরু হয়েছে৷ মো. ইউসুফ রাজনীতির কারণে বিয়েও করেননি৷ রাজনীতি অন্তপ্রাণ এই মানুষটি সারাজীবন রাজনীতি করে নিজের চিকিৎসার টাকা পর্যন্ত উপার্জন করেননি৷ অথচ বর্তমান রাজনীতিকদের অনেকেই কোটিপতি৷ নির্বাচনের বছর চলছে৷ অথচ আওয়ামী লীগের যেসব এমপি সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে, দলকে বেকায়দায় ফেলছে, তাদের ‘চিকিৎসার’ দায়িত্ব কে নেবে? বিশ্লেষকরা মনে করেন, দলীয় নেতা-কর্মীদের একটা অংশকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে এর মাশুল গুনতে হবে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একটা বড় ধরনের মূল্যবোধের অবক্ষয় আমরা লক্ষ্য করছি৷ আর এ কারণেই আগের সময়ের এমপিরা টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না৷ অন্যদিকে এখনকার এমপিদের অবস্থা তো আমরা দেখছিই৷’’ তাঁর মতে, ‘‘এই অবক্ষয় শুধু রাজনীতিবিদদেরই হয়েছে, এমন নয়৷ এটা সমাজের সব পেশার মানুষেরই হয়েছে৷ মো. ইউসুফ আদর্শিক রাজনীতির উদাহরণ৷ আর এখনকার এমপিরা মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পর এমপিদের উদাহরণ৷’’
নারায়নগঞ্জে ফুটপাথে হকার বসানো নিয়ে মেয়র আইভি রহমানের সঙ্গে সরাসরি বিরোধে জড়িয়েছেন এমপি শামীম ওসমান৷ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে প্রধান সড়কগুলো থেকে হকার উচ্ছেদ করা হচ্ছিল৷ উচ্ছেদ করা হকারদের জন্য হলিডে মার্কেটসহ বিভিন্ন স্থানে বিকল্প ব্যবস্থাও করা হয়েছিল৷ কিন্তু শামীম ওসমানের লোকজন উচ্ছেদকারীদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে৷ একজন তো সরাসরি অস্ত্র নিয়ে মেয়র আইভি রহমানকে গুলি করতে যান বলে অভিযোগ৷
এর আগে আওয়ামী লীগের কক্সবাজার এলাকার এমপি সাইমুম সরওয়ার কমল রামুতে একজন প্রবীণ শিককে লাঞ্ছিত করেছেন৷ সুনীল কুমার শর্মা নামের ওই শিক্ষককে জামার কলার ধরে গলা ধাক্কাও দেন তিনি৷ স্থানীয়রা বলছেন, সুনীল শর্মা ছিলেন এমপি সাইমুম সরওয়ার ও তার ভাই সোহেল সরওয়ার কাজলের শিক্ষক৷ এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর ছেলে ঢাকায় একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক৷ ওই সংগঠন সাইমুমের পছন্দ মতো চলছে না৷ সাইমুমের কথা শোনেননি সুলীল শর্মার ছেলে সুজন শর্মা৷ ছেলেকে হুমকি দিতে এসে তার বাবাকে লাঞ্ছিত করলেন সাইমুম৷ সাইমুমের বড় ভাই রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেলও প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘তার ভাইয়ের উচিৎ শিক্ষকের কাছে মাফ চাওয়া৷’’
এর আগেও কক্সবাজার এলাকার এমপি বদি সরকারী কর্মকর্তাদের পিটিয়ে আলোচনায় আসেন৷ তার বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মদত দেয়ার অভিযোগও এসেছে খোদ সরকারী তরফ থেকে৷ টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের এক নেতা হত্যার দায়ে আরেক এমপি আমানুর রহমান তো জেলেই আছেন৷ এমপিদের বিরুদ্ধে এমন অজস্র অভিযোগ৷ এর বাইরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠছে অনেক৷
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্র মাহবুব-উল-আলম হানিফ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যেসব এমপির বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ আছে, তারা আগামীতে মনোনয়ন পাবেন না৷ এটা নিশ্চিত৷ আর একটা দেশে তো কিছু ঘটনা ঘটতেই পারে৷ তবে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে কি-না সেটা মূল কথা৷ কোনো ঘটনায়ই ছাড় দেয়া হচ্ছে না৷ এমনকি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হলেও না৷ নারায়নগঞ্জের ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ইতিমধ্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ প্রশাসনকে বলা হয়েছে, দোষী যে-ই হোক, তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে৷ ইতিমধ্যে কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছে৷ অন্যরাও গ্রেফতার হবে৷ এখানে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই৷’’
গত এক সপ্তাহ আগে এম এইচ শমরিতা মেডিকেল কলেজের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি গালাগালি করে আলোচনায় এসেছেন সাবেক এমপি হাজি এম মকবুল হোসেন৷ মেডিকেল কলেজটির মালিক তিনি৷ ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ভাতা বৃদ্ধি ও বাড়তি ফি আদায় বন্ধসহ কয়েকটি দাবিতে বিক্ষোভ করছিলেন শিক্ষার্থীরা৷ সেখানে যান হাজি মকবুল৷ এরপর এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং খুলি উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন৷
পুরনো একটি বিপণী বিতান ভেঙে প্রকাশ্যে জায়গা-জমি জবর দখলের অভিযোগ উঠে নওগাঁর সাপাহার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলীর বিরুদ্ধে৷ সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে সাংবাদিকদের উপর হামলা হামলা চালিয়ে মারপিট করে ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয় শাহজাহানের ক্যাডাররা৷
সাম্প্রতিক সময়ে আরো কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার নামও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে অনাকাঙ্খিত ঘটনার কারণে৷
এসব বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে মানবাধিকার কর্মী নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ভর করেছে৷ রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই৷ আগে মানুষ রাজনীতি করত মানুষের জন্য৷ এখন রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করেন নিজের জন্য৷ এখন যারা এমপি, তাদের অধিকাংশই কোটি টাকার মালিক বা কোটি টাকা তিনি অপচয় করেন৷ এখন এই ধরনের রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে আমরা কি আশা করতে পারি? এ কারণে সম্প্রতি যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেটা তো ঘটবেই৷’’