নারী মুক্তিযোদ্ধা
২৯ আগস্ট ২০১২‘‘আমার বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের গাড়ি চালাতেন৷ তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বহন করতেন এবং তাঁদের খাবার ও রসদপত্র এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতেন৷ আমি এবং আমার বড় ভাই একদিন তাঁর গাড়িতে করে ২ নম্বর সেক্টর থেকে ১ নম্বর সেক্টরে যাচ্ছিলাম৷ উদয়পুরের কাছে ট্রাকের দরজা খুলে যায়৷ ফলে আমি গাড়ি থেকে পড়ে যাই এবং আমার মাথা ফেটে যায়৷ তখন আমার বড় ভাই তাঁর গায়ের জামা ছিঁড়ে আমার মাথা ব্যান্ডেজ করে আবার মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে আমাকে রেখে আসে'', মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার কথা বলছিলেন চট্টগ্রামের বীর নারী মুক্তিযোদ্ধা মধুমিতা বৈদ্য৷
মুক্তিযুদ্ধে আহত বীর সন্তানদের সেবা করার সময়ের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে আলো রানী বৈদ্য বলেন, ‘‘বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে আমরা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতে গিয়ে, তাঁদের দেহ থেকে গুলি বের করতে গিয়ে এমন পরিস্থিতি দেখতাম যে খুব কষ্ট হতো আমাদের৷ যেমন শেখ আলম নামে এক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন৷ তিনি আহত হয়ে আমাদের হাসপাতালে আসেন৷ সেখানে ডা. সিতারা এবং ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ আমরা ছিলাম৷ তাঁর বুক থেকে গুলি বের করতে গিয়ে যে রক্ত বের হয়েছে, সেই রক্তের ধারাটা যেন এখনও ঝর্ণার মতো বয়ে যাচ্ছে৷ সেই অবস্থায় মনে হতো যে, ঐ হাসপাতালে কাজ না করে অস্ত্র নিয়ে কাজ করাটাই ভালো ছিল৷''
বর্তমানে জোরারগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত মহিলা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মধুমিতা৷ ইউপি সদস্য হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘আসলে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা যখন আমাদের এলাকায় কাজ করতে আসে তখন তাদের কর্মসূচির অংশ হিসেবে আমি সমিতি গঠন করি৷ এভাবে এলাকায় কাজ করার ফলে সবাই ভাবতে শুরু করে যে, আমাকে দিয়েই তাদের কল্যাণ হবে৷ তাই অনেকটা জোর করেই তারা আমাকে ইউপি নির্বাচনে দাঁড় করায়৷ এভাবেই এখন আমি তাদের সেবা করছি৷ এছাড়া খান ফাউন্ডেশনের নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্পের সাথেও কাজ করছি আমি৷''
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতাল থেকে ক্যাপ্টেন সিতারা একটি সনদ পত্র প্রদান করেন৷ এছাড়া জেনারেল এমএজি ওসমানীর কাছ থেকেও একটি সনদ পান আলো রানী বৈদ্য৷ এছাড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে সরকারি সনদ পান তিনি৷ সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধাদের সাময়িকী এবং গেজেটেও তাঁর নাম প্রকাশিত হয়৷ কিন্তু সবধরণের কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারের কাছ থেকে এখনও কোনো সুযোগ-সুবিধা কিংবা ভাতা পাননি এই ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, আমি মিরসরাইয়ে আবেদন করেছি এবং আমার সকল প্রমাণপত্র রয়েছে৷ কয়েকবার আমি যোগাযোগ করেছি৷ কিন্তু তারা বলে, হবে, হচ্ছে৷ এরকম করেই তারা সময় পার করে দিচ্ছে৷ একবার বলল, গেজেট নিয়ে আসেন৷ তখন আমি গেজেট করে নিয়ে আসলাম৷ এরপর সাময়িক সনদ চেয়েছিল৷ সেটিও আমি কিছুদিন আগে পেয়েছি৷ তারপরেও তাদের অজুহাত, জুন-জুলাই মাস যাক৷ নতুন বাজেট আসুক, তখন হবে৷ এবাবে মহিলা হিসেবে আমাকে যতটুকু বঞ্চিত করা যায় তা তারা করে যাচ্ছে৷ এখন পর্যন্ত আমি কোনো কিছুই পাইনি৷''
প্রায় একই সুরে নিজেদের বঞ্চনার কথা জানান তাঁর বড় বোন মধুমিতা বৈদ্য৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার কাগজপত্র সবই আছে৷ এমনকি ১৯৯৬ সালে মুক্তিবার্তাতেও আমার নাম উঠেছে৷ এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটেও আমার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে৷ দৈনিক কালের কণ্ঠ আমার উপর প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং আমাকে একটি সংবর্ধনা দেয়৷ তারা এক লাখ টাকা দিয়েছিল৷ সেই টাকা দিয়ে আমি ছোট্ট একটা ঘর করেছি৷ এই হলো এখন পর্যন্ত প্রাপ্তি৷ এখনও পর্যন্ত সরকারি ভাতা পাইনি৷ ওনারা সরকারি ভাতা দেওয়া শুরু করবেন বলছেন, কিন্তু এখনও তা শুরু হয়নি৷''
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর নারীদের সাহসী ভূমিকা স্মরণীয় করে রাখতে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ঘটনা এবং অবদান সম্বলিত একটি বিশেষ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার দাবি জানান মধুমিতা বৈদ্য৷ এছাড়া সম্প্রতি তাঁর বড় ছেলে কনক কুমার দে দুষ্কৃতিকারীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়ায় ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করে স্বাধীন দেশে শান্তিতে জীবন যাপনের নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ