নারী মুক্তিযোদ্ধা
২২ আগস্ট ২০১২চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ১৯৫৬ সালের ১১ই মে জন্ম গ্রহণ করেন আলো রানী বৈদ্য৷ বাবা ক্ষিতিষ চন্দ্র বৈদ্য এবং মা মালতী রানী বৈদ্য৷ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় আবুল কাশেম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন আলো রানী৷ আর তাঁর বড় বোন মধুমিতা বৈদ্য পড়তেন নবম শ্রেণিতে৷
বাবা ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের সৈনিক৷ এছাড়া সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় দেশপ্রেমী ব্যক্তিত্ব৷ তাই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি নিজে যেমন যুদ্ধের কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন, ঠিক তেমনি নিজের ছেলেমেয়েদের দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য কাজে যোগ দিতে উৎসাহিত করেছেন৷ ফলে মা দুই মেয়েকে নিয়ে ভারত চলে যান৷ সেখানে গিয়ে আলো রানী এবং মধুমিতা বৈদ্য মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন৷
প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে ভারত যাওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ এবং বেদনাহত দিনগুলি সম্পর্কে আলো রানী বৈদ্য ডয়চে ভেলে'কে বলেন, ‘‘আমরা যখন দেশ ছেড়ে যাই, তখন আমার বয়স মাত্র ১৫-১৬ বছর৷ সেসময় নিজ দেশ ছেড়ে যাওয়ার বেদনা আমাকে খুব পীড়া দেয়৷ আর ভারতে গিয়েও বাবা আমাকে হাসপাতালে দিয়ে আসেন এবং বলেন যে, দেশের জন্যই এখানে এসেছো৷ দেশের জন্য কাজ করবে৷ বাবা-মা যে এভাবে দেশের জন্য আমাদের উৎসর্গ করেছিলেন সেটি ছিল অনেক বড় পাওয়া৷ ভারত যাওয়ার জন্য রওয়ানা হচ্ছি, তখন দেখলাম পাহাড়তলী থেকে রাস্তাঘাটগুলো ভেঙে দিচ্ছিল৷ আমরা শুধু ভয়ে ভয়ে ছিলাম যে কখন আমাদের উপর গোলা-গুলি এসে পড়ে৷ আকাশে শুধু বিমান উড়ে যাচ্ছিল৷ আমার মা প্রথমে আমাদের দুই বোনকে বাবার কাছে দিয়ে আসার কথা ভেবেছিলেন৷ কারণ আমার বাবা তখন সীমান্তের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের দল গঠন করছিলেন৷ কিন্তু তা হলো না৷ বরং বাবার পরামর্শ মতো মা আমাদের নিয়ে শুভপুর সেতুর পাশ দিয়ে ভারত নিয়ে যাচ্ছিলেন৷ তখনও সেখানে খুব গোলাগুলি হচ্ছিল৷ আমরা খুব কষ্ট করে নৌকায় নদী পার হয়ে যাই৷ ওটাকে হরিনাটিলা বলে৷ সেই পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ভারত সীমান্তে পৌঁছেছি৷ ভারতে যাওয়ার পর হরিনা শিবিরের পাশে মনুবাজারে এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলাম আমরা৷ কিছুদিন হরিনা শিবিরে কাজ করি৷ এরপর বাবা সেখানে গিয়ে আমাদেরকে বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে কাজ করার জন্য রেখে আসেন৷ সেখানে ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগমের নেতৃত্বে আমরা সেবিকা হিসেবে কাজ করেছি৷ এভাবে দুই নম্বর সেক্টরের আওতায় আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি৷''
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরে আবারো লেখাপড়া শুরু করেন আলো রানী বৈদ্য৷ তবে একইসাথে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজেও আত্মনিয়োগ করেন তিনি৷ এসময় তাঁর কাজ সম্পর্কে তিনি জানান, ‘‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ড ও নরওয়ে থেকে চিকিৎসক দল এসেছিল ১৯৭২ সালে৷ তখন ওদের সাথে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ত্রাণ বিতরণ ও চিকিৎসা সেবার কাজ করেছি আমরা৷ ইতিমধ্যে জোরারগঞ্জ বাজারে মহিলা ও শিশু কল্যাণ সমিতি গঠিত হয়েছিল৷ যুদ্ধের সময় নির্যাতিত ও স্বজনহারা নারীদের জন্য কাজ করতো এই সমিতি৷ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও ছিলেন এই সমিতির সাথে৷ স্বাস্থ্য মন্ত্রী জহুর আহমেদ চৌধুরী ছিলেন৷ সেখানে আমি সম্পাদিকা হিসেবে কাজ করেছি৷ কিন্তু আমি যখন দশম শ্রেণিতে পড়ছিলাম তখনই চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালে সেবিকা হিসেবে কাজে যোগদান করি৷''
বর্তমানে বন্দর হাসপাতালে ঊর্ধ্বতন সেবিকা হিসেবে কর্মরত আছেন আলো রানী বৈদ্য৷ ইতিমধ্যে তিনি বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা সহ বিভিন্ন স্থানে ও পর্যায়ে নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংবর্ধিত হয়েছেন৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ