মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
১৪ জুন ২০১২সংবিধান, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ৪০ বছরের ব্যর্থতা, সফলতা, রাষ্ট্র, প্রশাসন, অগ্রগতি ইত্যাদি নিয়ে চিন্তার শেষ নেই সারা হোসেনের৷ ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল'-এর প্রাক্তন কর্মকর্তা গীতা সেহগেল'এর নতুন ‘ইন্সটিটিউট' ‘সেন্টার ফর সেকিউলার স্পেস'-এও সম্প্রতি নিজের নাম লিখিয়েছেন তিনি৷ স্বপ্ন একটাই৷ মৌলবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো৷ কারণ সারার কথায়, ‘‘মৌলবাদকে সায় দিয়ে বা মৌলবাদীদের স্থান করে দিয়ে নানান ধরণের নীতি নির্ধারণ করা হচ্ছে৷ অনেক বিদেশি দাতা সংস্থা আজকাল ‘ইন্টারফেথ প্রোগ্রামস'-এর নামে শেষ পর্যন্ত কিন্তু মৌলবাদী সংগঠনগুলোকে ‘সাপোর্ট' করছে৷ মানে বিদেশি সাহায্য দিতে গিয়ে দেখা গেছে মাদ্রাসা ইত্যাদিকে কম্পিউটার পাঠানো হচ্ছে৷''
মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রথম প্রজন্মের একজন হিসেবে সারা কিন্তু অনেক জিনিসই একটু অন্যভাবে দেখেন৷ তাঁর মতে, মুক্তিযুদ্ধ কেন করা হলো, সেই বিষয়টা আবারো বিবেচনা করা উচিত৷ আর তাই, বাংলাদেশের পটভূমিতে এ ধরণের ‘সেকিউলার স্পেস'-এর গুরুত্ব অনেক, জানান সারা হোসেন৷ বলেন, ‘‘‘সেকিউলার স্পেস'-এর গুরুত্ব এখন তো আরো বেশি, কারণ, ‘অরিজিনালি' আমাদের ৭২'এর সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা ছিল৷ অর্থাৎ ধর্মের কোনো নাম-গন্ধ ছিল না৷ তবে এটুকু ছিল যে যাঁর যাঁর ধর্ম, তাঁর কাছে৷ এবং প্রত্যেকের নিজের ধর্ম পালন করার অধিকার অবশ্যই রাষ্ট্র সংরক্ষণ করবে৷ অথচ গত বছর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করে ফেলা হলো৷ এটাতে আমরা যাঁরা অসাম্প্রদায়িকতাতে বিশ্বাস করি, তাঁরা বড় একটা ধাক্কা খেয়েছি৷ এটা মুক্তিযুদ্ধের মূল কাঠামোর বিরুদ্ধে৷''
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে অবশ্য সারা খুবই ইতিবাচক৷ অনেক আন্দোলনের ফসল এই বিচার প্রক্রিয়া৷ কিন্তু যৌক্তিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, বিচারটা কী রকম হওয়া উচিত? ‘‘যারা এত বছর ধরে এই বিচারের জন্য অপেক্ষা করেছেন, তারাও নিশ্চয়ই চাইবেন না এখানে কোনো ক্যাঙ্গারু কোর্ট স্থাপন করা হোক৷ কাউকে ঝুলিয়ে ফেলা হোক৷ আমাদের সকলের আকাঙ্ক্ষা, সঠিকভাবে বিচার হোক৷ এমনভাবে হোক যা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি'', জানান সারা৷
বর্তমান সরকার তাদের নির্বাচনের সময় অনেক ধরণের প্রতিশ্রুতি করেছিল৷ এটাও বলেছিল যে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার তারা সংরক্ষণ করবে৷ অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের আইনটি পাশ করলেও, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অবস্থা কিন্তু তথৈবচ৷ সারা হোসেন বলেন, ‘‘সিএইচটি অনেক বেশি কঠিন অবস্থায় আছে৷ বলা হচ্ছে যে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করা হবে৷ অথচ বাস্তবে এক্ষেত্রে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না৷ আমরা এ ধরণের চিঠি-পত্র পেয়েছি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে গেলে আমরা যেন শুধু পাহাড়িদের সঙ্গে কথা না বলি, যাওয়ার সময় যাতে আমাদের সঙ্গে সরকারি কোনো কর্মকর্তা থাকেন৷ এটা কেন হবে? একজন বাংলাদেশি নাগরিকের সঙ্গে স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার আমাদের থাকবে না কেন?''
এখানেই শেষ নয়৷ সারা হোসেন জানান, ‘‘ইদানিং আমরা শুনেছি যে, শোকের মাসে আদিবাসী জনগোষ্ঠী আদিবাসী দিবস পালন করতে পারবেন না৷ ১৫ই অগাস্ট যে শোক দিবস - তা আমরা সকলেই জানি৷ কিন্তু শোকের মাস বলে তো কিছু ছিল না৷ যাঁরা সংখ্যালঘু বা যাঁরা প্রান্তিক, তাঁদের অধিকার নিয়ে যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা আদৌ চিন্তা করেন কি না - সে জায়গা থেকে একটা অনাস্থা বা অবিশ্বাসের জায়গা তৈরি হয়েছে, যেটা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য সত্যিই বিপজ্জনক৷''
সারার বক্তব্য, ‘‘বর্তমান সরকার সংবিধান নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা করছে৷ আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে এত আলাপ-আলোচনা করে কোনো লাভ নেই৷ কারণ শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবার যা বলবেন, তাই হবে৷ এ দেশে গণতন্ত্রের ভান চলছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা লোক দেখানো বুলি ছাড়া কিছু নয়৷ তাই সেই প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের যে স্বপ্নগুলো ছিল, যে ভিত্তি ছিল, সেগুলো পূরণ করার ক্ষেত্রে আমাদের এখনও অনেকদূর যেতে হবে৷''
প্রতিবেদন: দেবারতি গুহ
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন