স্বাধীনতা পুরষ্কার
১৩ জুন ২০১২‘‘ফরিদগঞ্জ এলাকায় আমাদের ক্যাম্পের একটি ছেলে সম্মুখ যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়৷ তার নাম ফারুক৷ আমার কাছে তখন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছিল না৷ তবুও আমি তার গুলি বের করতে সক্ষম হই৷ কিন্তু তার যে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছিল তা কোনোভাবেই বন্ধ করতে পারিনি৷ এমনকি তাকে তখন অন্য কোথাও চিকিৎসার জন্য পাঠানোরও কোনো উপায় ছিল না৷ ফলে আমি অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারিনি৷ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সে আমার সামনে মারা যায়৷'' অফিস চিতোষী বিদ্যালয়ের সেই নির্যাতিত মহিলাকেগুলোকে বাঁচাতে পারলেও ফারুক নামের এই মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে না পারার বেদনার কথাই বলছিলেন ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী৷
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চাঁদপুরসহ কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলে নৌকায় করে ঘুরে ঘুরে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন ডা. বদরুন নাহার৷ কিন্তু যুদ্ধের সময় কোনো এলাকাতেই বেশি দিন অবস্থান করতে পারতেন না৷ কোনো বাড়িতে দুয়েকদিন থাকলেই সে এলাকায় খবর হয়ে যেত যে, এখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা এসেছে৷ সে কারণে খুব ঘন ঘন জায়গা পাল্টাতে হতো৷ এছাড়া দিনের বেলায় চলাফেরা করলে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল৷ তাই রাতের আঁধারে নৌকায় করে বিভিন্ন জায়গা যেতেন তিনি৷ তবুও একাধিকবার পাক সেনাদের কবলে পড়েছেন এই সাহসী নারী৷
এমন বিপদজনক মুহূর্তে কীভাবে পাক সেনাদের কবল থেকে উদ্ধার পেয়েছেন সেসব ঘটনা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের এলাকায় বড় একটা সেতু আছে৷ ঐ সেতুর নীচ দিয়ে যখন আমার নৌকা যাচ্ছিল, তখন পাক সেনারা আমাকে থামায়৷ কিন্তু যুদ্ধের সময় থেকে আমি আমার স্বাভাবিক কাপড়-চোপড় না পরে বরং বোরকা পরে ছদ্মবেশে থাকতাম৷ ওরা আমার নৌকা আটকায়৷ আটকিয়ে মাঝিকে জিজ্ঞেস করে৷ তখন মাঝি কোনো একটা জায়গার নাম বলে যে, উনাকে সেখানে রাখতে যাচ্ছি৷ এছাড়া আমার দুয়েকটা কথাবার্তাতেও তারা আমাকে সেই বার আর সন্দেহ করেনি৷ ফলে সেই দফা ছেড়ে দেয়৷ আরেকবার অনেক রাত্রে আমি নৌকা দিয়ে যাচ্ছি৷ পাক সেনারা আমার নৌকা আটকায়৷ তখন আমার মাঝি আমাকে বলে, খালাম্মা, আপনি পানিতে নেমে যান৷ আমি তো প্রথমে খুব আঁৎকে উঠলাম তার কথা শুনে৷ কিন্তু তারপরও উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত পানিতে নেমে পড়ি৷ নৌকার পেছন দিক ধরে পানিতে ভাসতে থাকি৷ পাক সেনারা নৌকাটা ভালোভাবে দেখল যে, তাতে কেউ নেই৷ মাঝিকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে যে, সে খালি নৌকা নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে৷ তখন ওরা নৌকাটা ছেড়ে দিল৷ কিন্তু আমি যখন নৌকা ধরে পানিতে ছিলাম তখন আমার মনে হলো পাশ দিয়ে কী যেন ভেসে যাচ্ছে৷ সেই মুহূর্তে জীবনের ভয় তো সবারই হবে৷ তারপর সৈন্যরা যখন চলে গেছে তখন আমি ভালোভাবে দেখি যে, আমার পাশ দিয়ে দুই তিনটা মৃতদেহ ভেসে গেছে৷''
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এমবিবিএস পরীক্ষা সম্পন্ন করেন বদরুন নাহার৷ এরপর চিকিৎসক হিসেবে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন তিনি৷ চাকুরির এক পর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান ডা. বদরুন নাহার৷ সেই পদে থেকেই ২০০৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন তিনি৷ তবে চাকুরি থেকে অবসর নিলেও এখনও সেই মহান পেশায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন৷ পাশাপাশি সমাজ সেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন এই নারী৷ এছাড়া তিনি এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের এবং তাদের সন্তানদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করেন বলে জানান ডা. বদরুন নাহার৷
স্বাধীনতা যুদ্ধে ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরীর গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকার জন্য ২০১২ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়৷ বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে তাঁর হাতেও স্বাধীনতা পুরস্কার তুলে দেন৷ এই সম্মানজনক পুরস্কার প্রাপ্তি সম্পর্কে তাঁর অভিব্যক্তি, ‘‘বর্তমান জোট সরকার, স্বাধীনতার পক্ষের সরকার, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা আমি যে মুক্তিযুদ্ধে কাজ করেছি তারই স্বীকৃতি স্বরূপ আমাকে পদক দিয়েছেন৷ আমি মনে করি, এটা আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পাওয়া৷ এজন্য আমি সকল মুক্তিযোদ্ধার পক্ষ থেকে এবং চাঁদপুর জেলাবাসীর পক্ষ থেকে সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাই৷''
তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘‘আমরা দেশকে স্বাধীন করেছি৷ এখন এই স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং দেশকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলার দায়িত্ব তাদের৷ বাংলাদেশ যেন গোটা বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে - সেজন্য আমরা যেমন দায়িত্বশীল হবো, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও তেমনি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে এটিই আমার বিশ্বাস এবং প্রত্যাশা৷''
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ