সংকটে স্পেন
২১ অক্টোবর ২০১২দায়ে পড়লে মানুষ কতো কিছুই না ভাবে, কতো কিছুই না করে৷ ইউরোপের সেরা সেরা শহরগুলোও দৃশ্যত তার ব্যতিক্রম নয়৷ তাই মাদ্রিদের পৌরপিতারা মার্কিন বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে মাথা খাটিয়ে ঋণ সংকট সামলানোর একটা পন্থা বার করেছেন: ইউরোপে সভ্যতা, সংস্কৃতির অন্য সব নিদর্শন থাকতে পারে, কিন্তু লাস ভেগাস তো নেই৷ কাজেই মাদ্রিদের দোরগোড়ায় একটা ইউরোভেগাস সৃষ্টি করলে কেমন হয়?
মাদ্রিদের ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে আলকর্কন শহরতলি৷ সেখানে লাস ভেগাসের কায়দায় একটি সুবিশাল ক্যাসিনো কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হবে৷ বারোটি হোটেলে মোট ৩৬,০০০ ঘর থাকবে৷ সেই সঙ্গে ছ'টি ক্যাসিনোয় রুলেট খেলার অন্তত এক হাজার টেবিল, সেই সঙ্গে আঠেরো হাজার পিনবল মেশিন৷ এছাড়া একাধিক থিয়েটার ও গল্ফ ক্লাব৷ এবং পনেরো হাজার দর্শকের একটি স্টেডিয়াম৷
প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হচ্ছে ১৭ বিলিয়ন ইউরো৷ শুধু নির্মাণপর্বেই আড়াই লাখ মানুষ চাকরি পাবে, বলে আশা করছেন মাদ্রিদের পৌর প্রশাসন এবং মার্কিন বিনিয়োগকারীরা৷ ঋণ সংকটে স্পেনের অন্যান্য বহু শহরের মতো মাদ্রিদেরও হাত শূন্য, ভাঁড়ার খালি৷ কাজেই ইউরোভেগাসের মতো একটি প্রকল্প থেকে যদি হঠাৎ অর্থবৃষ্টি শুরু হয়, তা'তে পৌর কর্মকর্তাদের আপত্তি কোথায়?
কিন্তু আলকর্কন, যেখানে ইউরোভেগাসের মায়াপুরী সৃষ্টি হবে, সেখানকার বাসিন্দারা খুব খুশি নন৷ তাছাড়া এই দৈত্যাকার প্রকল্পের অর্থনৈতিক যৌক্তিকতাও সকলের কাছে পরিষ্কার নয়৷ ‘ইউরোভেগাস নো' বা ‘ইউরোভেগাস নয়' প্রতিরোধ আন্দোলনের মুখপাত্র আনা রেভুয়েল্টা বলেন:
‘‘প্রকল্পের প্রতি ওটাই আমাদের মূল সমালোচনা৷ যে অর্থনৈতিক আদর্শ থেকে আজ আমাদের এই সংকট, সেই অ-টেকসই মডেলে ফিরে গিয়ে যে আমরা সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারব, তা' আমরা মনে করি না৷ এর ফলে সংকট শুধু আরো ঘনীভূত হবে৷''
এছাড়া মার্কিন বিনিয়োগকারীরা অথবা মাদ্রিদ প্রশাসন, কোনো তরফই প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত নন৷ বাসিন্দা কিংবা নাগরিকদের সব কিছু ঠিক মতো করে কোনোকিছুই বলা হচ্ছে না৷ ইউরোভেগাস বিরোধীদের খবর অনুযায়ী প্রকল্পের মোট বিনিয়োগের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ আসবে লাস ভেগাস স্যান্ডস নামধারী সংস্থাটির কাছ থেকে৷ বাকিটা ব্যাংকের কাছ থেকে ধার নিতে হবে৷
তবে আলকর্কন'এর রাজমিস্ত্রি, ছুতোর মিস্ত্রি গোত্রীয় মানুষ, কিংবা কাঠগুদাম, লোহালক্কড়ের দোকানদাররা মুনাফা করার স্বপ্ন দেখছেন৷ জোসে আন্তোনিও বাড়ি তৈরির মালমশলার দোকানদার৷ তিনি বলেন:
‘‘এই প্রকল্পটা শুরু হলে দারুণ হবে৷ এখানে যে পরিমাণ বেকারত্ব, তা'তে আমাদের চাকরির দরকার৷ তা'হলে এতোদিন পরে আবার বাড়ি তৈরির ব্যবসায় কিছুটা প্রাণ ফিরবে৷''
ইউরোভেগাসের কাজ শুরু হবার কথা ২০১৬ সালে৷ শেষ হবে ২০২২'এ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাস স্যান্ডস'এর দৃষ্টিতে এই প্রকল্প হল তাদের প্রেস্টিজ প্রকল্প৷ এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এবং এশিয়ার পর ইউরোপেও ঘাঁটি গাড়ার স্বপ্ন দেখছে লাস ভেগাস স্যান্ডস৷ সংস্থার প্রধান মাইক লেভেন ইতিমধ্যেই ঢাক পেটাচ্ছেন:
‘‘আমরা কর থেকে আদায় বাড়াই, চাকরি তৈরি করি, পর্যটন বাড়াই৷ এবং তাই দিয়ে আমরা জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম এবং এবার স্পেনের মতো দেশে যাচ্ছি৷ সেটাই হল আমাদের ব্যবসা৷''
নাগরিক অধিকার আন্দোলনকারী আনা রেভুয়েল্টা কিন্তু এ'সব চটকে ভুলতে রাজি নন৷ ‘ইউরোভেগাস নো' আন্দোলনের হিসেব অনুযায়ী, প্রকল্পের উদ্যোক্তারা যা বলছেন, তার মাত্র ২০ শতাংশ চাকরি সৃষ্টি হবে৷ তা'ও আবার যতোদিন নির্মাণের কাজ চলবে, ত'তোদিন অবধি৷ তার পরে থাকবে শুধু হোটেল-রেস্তোরাঁর কম মাইনে, এবং কম নিরাপত্তার চাকরি:
‘‘লাস ভেগাস স্যান্ডস কোম্পানি শ্রমিক সংগঠন গঠনের অনুমতি দেয় না৷ সিঙ্গাপুর কিংবা ম্যাকাও'তে তাদের যে সব কোম্পানি আছে, সেখানকার শ্রমিকরা স্পেনের শ্রমিকদের মতো চাকুরির নিরাপত্তার কোনো গ্যারান্টি পায় না৷''
ওদিকে মাদ্রিদের ইউরোভেগাস ব্যবসা লাভজনক না হলে, লাস ভেগাস স্যান্ডস আবার পাততাড়ি গুটোবে৷ কিন্তু অবকাঠামোয় অনর্থক অর্থব্যয়ের দায়টা মাদ্রিদের করদাতাদেরই থেকে যাবে৷
প্রতিবেদন: রাল্ফ বোজেন/এসি
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন