স্পেনে ঋণ সংকটের আসল চেহারা
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১২সেভিইয়ার কাছে একটি খালি পড়ে থাকা বাড়িতে ৩৬টি আশ্রয়হীন পরিবার গত তিন মাস ধরে বাস করছেন৷ নির্মাণ সংস্থাটি বন্ধকী ধার না মেটাতে পেরে দেউলিয়া হয়ে যায় এবং বাড়িটার কাজ শেষ করতে পারেনি৷ ওদিকে আন্দালুসিয়ার এই শহরটিতে বেকারত্বের হার ৩০ শতাংশ৷ বাড়িটাতে যারা আশ্রয় নিয়েছেন, তারা তাদের বাসস্থানের নাম দিয়েছেন ‘‘ইউটোপিয়া'' বা ‘কল্পলোক'৷
মার্সেডেস এখানে তাঁর মেয়ে এবং নাতনিকে নিয়ে থাকেন৷ গ্রীষ্মে চরম গরম, অথচ কলে জল নেই৷ মার্সেডেস ও তাঁর পরিবারের অন্যান্যরা প্রতিবেশীদের সাহায্য এবং দয়ামায়ার উপর নির্ভরশীল৷ প্রতিবেশীরাই সাত মাস বয়সি বাচ্চাটার জন্য প্লাস্টিকের বালতিতে পানি, সঙ্গে খাবারদাবার কিংবা অন্যান্য জিনিষ দিয়ে যায়৷ নয়তো মার্সেডেস ও তাঁর মেয়ে কি নাতনির জন্য গোটা কয়েক হাওয়া ভরার বিছানা আর পুরনো পিচবোর্ডের বাক্স ছাড়া আর কিছু নেই৷
‘কল্পলোক' বাড়িটির বাসিন্দাদের অবস্থা স্পেনের অনেক মানুষের কাছেই আর কোনো দুঃস্বপ্ন নয়, বরং বাস্তব হয়ে ওঠার পথে৷ সরকার ব্যয়সংকোচের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন সামাজিক সুযোগসুবিধা ছাঁটার ফলে পরিস্থিতি আরো চরমে উঠেছে৷ প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাখয় বাজেট থেকে ৬৫ বিলিয়ন ইউরো কমাতে চান৷ ওদিকে বিক্রয় কর চড়ছে ১৮ থেকে ২১ শতাংশে৷ মার্সেডেসের অবস্থা: ‘‘আমি কোনো বেকার ভাতা কিংবা অন্য কোনো ধরণের আর্থিক সাহায্য পাই না৷ শুধুমাত্র আমার ছোট্ট নাতনির জন্য ২৮০ ইউরো পাই, কেননা আমার মেয়ে একা এবং তার কোনো চাকরি নেই৷''
ঋণ সংকটের আগে মার্সেডেস ছিলেন পেশায় রাঁধুনি এবং সেভিইয়ার স্বাস্থ্য দপ্তরের হয়ে কাজ করতেন, ডয়চে ভেলে'কে জানালেন মার্সেডেস৷ গতবছর ব্যয়সংকোচের তাড়নায় তাঁর চাকরি যায়৷ অন্য কোনো কাজও খুঁজে পাননি তিনি৷ হঠাৎ পথে দাঁড়াতে হয় তাঁকে, যা কিছু আছে, তা নিয়ে, সন্তানসম্ভবা মেয়ের হাত ধরে৷
সেভিইয়ার 'কল্পলোকের' আর দুই বাসিন্দা ফ্র্যান এবং ইন্মা৷ ফ্র্যান এককালে বিমা বিক্রি করতেন, মাসে প্রায় ৩০০ ইউরো আয় ছিল৷ ঐ অর্থে স্ত্রী এবং তিনটি শিশুসন্তানের ভরণপোষণ করা সম্ভব নয়, বাড়ি নেওয়া তো নয়ই৷ তাই স্ত্রী ইন্মা বাচ্চাদের নিয়ে বাপের বাড়িতে আশ্রয় নেন, ফ্র্যান থাকে অন্যত্র৷ দু'বছর এভাবে কাটার পর তাঁরা ‘কল্পলোকের' হদিশ পান৷ ফ্র্যান জানান: ‘‘আমি কোনো বেকার ভাতা পাই না, কেননা চাকরি থাকার সময় আমি ঐ তহবিলের জন্য আগে কিছু কাটাইনি৷ এখন আমরা শুধু আমার শ্বশুর-শাশুড়ি এবং বাবা-মায়ের সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে পারি৷''
গোটা স্পেনে বেকারত্বের হার এখন ২৪ শতাংশ৷ প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্যে একটি এখন দারিদ্র্য এবং সামাজিক পতনের ঝুঁকিতে৷ ইউরোপে শুধুমাত্র রোমানিয়া এবং লাটভিয়ার পরিস্থিতি স্পেনের চেয়েও খারাপ৷
সেভিইয়া'র ‘কল্পলোকের' আরেক বাসিন্দা ভ্যানেসা'র কাহিনি শুনলে চোখে জল আসে৷ মহিলার তিনটি সন্তানের একটি গুরুতরভাবে প্রতিবন্ধী এবং প্রতিদিন তার বিশেষ চিকিৎসা লাগে৷ এজন্য ভ্যানেসার অর্থসাহায্য পাবার কথা৷ কিন্তু পৌর কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছেন, বর্তমানে ব্যয়সংকোচ চলার কারণে সে ধরণের সব সাহায্য স্থগিত রাখা হয়েছে৷
যে অফিস-কাছারি পরিষ্কার করার কোম্পানিতে ভ্যানেসা ও তাঁর স্বামী কাজ করতেন, সেও লাটে উঠেছে৷ সেযাবৎ পরিবারটির কোনো রোজগার নেই৷ অথচ কোম্পানি দু'জনের ছ'মাসের মাইনে বকেয়া রেখেছে, থোক টাকা যা দেবার ছিল, তাও দেয়নি৷ ভ্যানেসার পরিস্থিতি:
‘‘বেকার ভাতার টাকা ফুরিয়েছে৷ এখন আমরা পুরোপুরি খ্রিস্টান নান'দের দয়া এবং আমার বাবা-মায়ের উপর নির্ভর৷ আমার স্বামী ফেলে দেওয়া জিনিষপত্র বেচে কিছুটা রোজগার করেন, কিন্তু তাও প্রায় কিছুই নয় - দিনে চার ইউরোর মতো৷''
স্পেনে ঋণসংকটের টানে যে ব্যয়সংকোচের চাপ, তার মূল বোঝাটা টানছে সমাজের সবচেয়ে দুর্বল, দরিদ্র শ্রেণির মানুষ - বলছে শ্রমিক সংগঠনগুলো৷ এ'মাসের মাঝামাঝি তারা আবার রাজধানী মাদ্রিদের কেন্দ্রে বিরাট প্রতিবাদ সমাবেশ করবে৷ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, বলেছে তারা৷
প্রতিবেদন: নুরিয়া গার্সিয়া রেচে/এসি
সম্পাদনা: জাহিদুল হক