মমতাকে ‘বাধ্য বালিকা' করেছেন প্রশান্ত কিশোর
২১ আগস্ট ২০১৯গত সাত বছরের শাসনে বাংলায় বেশ কিছুটা জনসমর্থন হারিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার৷ তাঁর তৈরি দল তৃণমূল কংগ্রেসের ওপর আস্থা হারাচ্ছে আম জনতা৷ বিষয়টা বুঝতে একটু দেরি করেছেন স্বয়ং তৃণমূল নেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা৷ ২০২১-এ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন৷ রাজ্যের রাজত্ব কার হাতে, তা নির্ধারণ হবে৷ এমন এক কঠিন সময়ে মমতার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলের হাইটেক নেতা ডেরেক ও'ব্রায়েন ডেকে এনেছেন দুঁদে নির্বাচনী কৌশলী প্রশান্ত কিশোর বা পিকে-কে৷
পিকে যে দলের হয়ে কাজ করেন, রাজনৈতিক দলের চলার পথ, প্রচার কৌশল সব ঠিক করে দেন তিনিই৷ এর আগে তিনি যেখানে যে দলকে নির্বাচনে জেতানোর দায়িত্ব নিয়েছেন, সেখানে তিনিই সর্বেসর্বা৷ তাঁর কথা শুনে চলতে হয় দলের সর্বস্তরের নেতাকে৷ তৃণমূলেও সেই চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি৷ প্রশাসনে দুর্নীতি, সরকারি প্রকল্পে কাটমানি(প্রাপ্য অর্থের একাংশ কেটে নেওয়া) এবং সর্বস্তরের নেতাদের বেপরোয়া কর্মকান্ডে তিতিবিরক্ত জনতা৷ এই সুযোগে পশ্চিমবঙ্গে তিল থেকে তাল-এর আকার নিচ্ছে ভারতীয় জনতা পার্টি৷ এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলকে ঢেলে সাজাতে দলের নেতা-নেত্রীদের একগুচ্ছ কর্মসূচি দিয়েছেন প্রশান্ত কিশোর বা পিকে৷ যা নিয়ে দলের অন্দরেই ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে৷ পিকে অবশ্য তাতে কর্ণপাত করতে নারাজ৷ তাঁর সাফ কথা, ‘‘হয় আমার কথা শোনো, নয়তো দূর হটো৷''
ঘনিষ্ঠ মহলে পিকে বলছেন, তিনি এখনও সেইভাবে কাজ শুরুই করেননি৷ এরমধ্যে সুফল মিলেছে৷ গত মে মাসে তৃণমূলের ওপর আম জনতার যে বিতৃষ্ণা ফুটে উঠেছিল, এখন তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে৷ দলের অন্য নেতা-নেত্রীদের তিনি বাগে আনতে পারলেও বেগ পেতে হচ্ছে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে নিয়ে৷ কারণ, অন্যের কথা শুনে চলা মমতার ধাতে নেই৷ যদিও তিনি শুনতে বাধ্য হচ্ছেন৷ চরম অনিচ্ছা সত্ত্বেও পিকে-কে মেনে নিতে হচ্ছে তাঁকে৷ তাঁর হাঁটাচলা, কথা বলা এমনকী সরকারি কর্মসূচির গতিমুখ পর্যন্ত নির্ধারণ করে দিচ্ছেন পিকে৷ মানছেন আলটপকা মন্তব্যে কড়া নিষেধাজ্ঞাও৷ তবে, গদি হারানোর ভয়ে ধীরে ধীরে বাধ্য বালিকা হয়ে উঠেছেন একদা বাংলার বাঘিনী৷
পিকে ঠিক করেছেন, আগামী বিধানসভা নির্বাচন তিনি লড়বেন শুধুমাত্র মমতাকে সামনে রেখে৷ আশেপাশে থাকবেন না আর কেউই৷ অভিষেকও নয়৷ এতদিন তা-ই হয়ে এসেছে৷ কিন্তু, সাত বছরে দলের বহু শাখা-প্রশাখায় ভুঁইফোড় নেতা, নেত্রী মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন৷ সমস্যা তাঁদের নিয়েই৷ তাই মমতাকে আবার ‘দিদি'-র রূপ দিচ্ছেন পিকে৷ চালু করেছেন ‘দিদিকে বলো' কর্মসূচি৷ তৃণমূলের এক হাজার নেতাকে বেছে ১০০ দিনের মধ্যে নিয়ে তাঁদের ১০ হাজার গ্রামে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন৷ কোন নেতা কোন গ্রামে যাবেন, সেসব ঠিক করে দিচ্ছেন তাঁর টিম৷ গ্রামে গিয়ে রাত কাটাতে হচ্ছে নেতাদের৷ কার বাড়িতে থাকতে হবে, তা-ও ঠিক করে দিচ্ছে টিম-পিকে৷ এমনকী, সেইসব ছবি আপলোড করতে হচ্ছে পিকে-র ঠিক করে দেওয়া নম্বরে৷ পিকে বলেছেন, ‘‘সবে শুরু৷ প্রথমে নেতাদের ভাবমূর্তি শুধরোতে হবে৷ নির্বাচনী প্রচার ঢের দেরি৷'' বাংলায় টিম-পিকে মোট ৭০০ কর্মী নামিয়েছে৷ প্রতি মুহূর্তে নেতা-মন্ত্রীদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে৷ নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে পিকে বলেছেন, ‘‘আপনারা নিজেদের এলাকায় কেন হেরেছেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলুন৷ তবে, বিজেপির সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গ বলার প্রয়োজন নেই৷ কারণ ওটা আমরা জানি৷'' এতেই ফাঁপরে পড়েন বেশিরভাগ নেতা৷ তারপর পিকে-র বিধান, ‘‘গ্রামে যান৷ মানুষের সঙ্গে মিশুন৷ অযথা বিজেপি-কে দোষারোপ করে কেউ পার পাবেন না৷ নিজের মূল্যায়ন করতে হবে নিজেকেই৷'' ইঙ্গিত দিয়েছেন ২০২১ সালে কমপক্ষে ২০-২৫ শতাংশ বিধায়ক প্রার্থীপদ থেকে পড়বেন৷
পিকে ঘনিষ্ঠরা বলছেন, এরপর দুর্গাপুজোয় ‘টাস্ক' দেওয়া হবে নেতাদের৷ কী টাস্ক? নেতা-মন্ত্রীদের সব পুজো মন্ডপে গিয়ে মুখ দেখিয়ে চলে এলে হবে না৷ পুজোকর্তাদের সঙ্গে, দর্শনার্থীদের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে৷ পুজো মিটলেই প্রতি তিন মাস অন্তর নতুন কর্মসূচি৷
ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ‘‘বেশ কয়েক বছর ধরে তৃণমূল দলটা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিল, প্রশান্ত কিশোর সেই জায়গায় দলকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করেছেন৷ বিশেষ করে দলনেত্রী মমতা ব্যানার্জি, যিনি কারও কোনও কথা শোনেন না, তাঁকে এখন প্রশান্ত কিশোরের কথা শুনতে হচ্ছে৷ মমতার পর তৃণমূলে প্রশান্ত কিশোরই এখন দ্বিতীয় ব্যক্তি৷'' তাঁর মতে, ‘‘যে লড়াইটা বিজেপি একতরফা ভাবে জিতে নিয়ে চলে যাচ্ছিল, প্রশান্ত কিশোর আসার পর সেই লড়াইয়ে টিকে রয়েছে তৃণমূল৷ অন্তত এখনও৷''
পিকের জন্ম বিহারের রোহতাস জেলার কোরান গ্রাম৷ লেখাপড়ার পর রাষ্ট্রপুঞ্জের স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরি করেছেন৷ ২০১১ সালে ভারতে ফিরে গড়েছেন ‘সিটিজেন্স ফর অ্যাকাউন্টেবল গভর্নমেন্ট' বা সিএজি৷ তাতে সর্বোচ্চ মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আইআইটি ও আইআইএম উত্তীর্ণদের নিয়োগ করেছেন৷ কাজ আধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কার করে নির্বাচনী কৌশল বাস্তবায়িত করা৷ কৌশলী হিসেবে তাঁর প্রথম নিয়োগকর্তার নাম নরেন্দ্র মোদী৷ গুজরাটে মোদীকে জিতিয়ে ছিলেন তিনি৷ বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারকেও মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছেন তিনিই৷ পিকে ঘনিষ্ঠরা বলছেন, ‘‘উনি অত্যন্ত পেশাদার মানুষ৷ কোনও দল বা রাজ্যকে ভালোবাসতে যাননি৷ অক্ষরে অক্ষরে তাঁর কথা শুনলে সুফল মিলবে, নয়তো গড্ডলিকা৷ কারণ বিজেপি-র সঙ্গে তৃণমূলের লড়াইটা মোটেও সহজ নয়৷''