ভাষা-সাহিত্যের বিশ্বযোগের মেলা
১৫ অক্টোবর ২০১৮এক দেশের প্রকাশকদের সঙ্গে অন্য দেশের প্রকাশকদের যোগাযোগ, বইয়ের সত্ত্ব কেনা-বেচা হয় এখানে৷ তবে আমাদের চেনা বইমেলার মতো বই বিক্রির ব্যাপার নেই এই মেলায়৷ এবারো সাত হাজারের বেশি প্রকাশনা সংস্থা অংশ নিয়েছে মেলায়৷ একেকটি ভবনের একেকটি ফ্লোরে স্টল নিয়ে বসেছেন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দেশগুলোর বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা৷ সেখানে আপনি যেমন ইউরোপ, আমেরিকা, ল্যাটিন আমেরিকার বই পাবেন তেমনি রয়েছে আফ্রিকা, এশিয়াসহ বিশ্বের সব কোণের প্রতিচ্ছবি৷ প্রতিটি স্টল, গ্যালারি হয়ে উঠেছে একেকটি অঞ্চলের দেশের সমাজ-সংস্কৃতির প্রতিরূপ৷ এক মঞ্চে এতে সংস্কৃতির উপস্থাপন যেন পুরো বিশ্বকে তুলে ধরে ছোট ক্যানভাসে৷
১০ অক্টোবর শুরু হওয়া এই মেলার শেষ দুই দিন ছিল দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত৷১৩ অক্টোবর (শনিবার) সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার৷ খুঁজে খুঁজে বই বেছে কিনতে না পারার জন্য কিছুটা দুঃখবোধ ছিল৷ কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই মন ভালো হয়ে যায় বিভিন্ন গ্যালারি ঘুরে৷ ফুটবল মুগ্ধতায় অনেক আগ্রহ ব্রাজিলের প্রতি, ল্যাটিন অ্যামেরিকার দেশটির স্টলে গিয়ে মন ভরে যায়৷ এ যেন এক টুকরো ব্রাজিল, স্টলের নানা কোণে টাঙানো ছবি, বিভিন্ন তাকে সাজানো বইয়ে যেন ব্রাজিলের ছাপ আসছিল৷ তার পরেই দেখি বিশ্বজুড়ে নন্দিত ফুটবলের আরেক দেশ আর্জেন্টিনার গ্যালারি৷ এদের উল্টো পাশেই দেখা যায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর স্টল, ছবি আর বইয়ে সাজানো স্টলগুলো যেন ফুটিয়ে তুলছিল দেশগুলোকে৷
এ রকম বিভিন্ন গ্যালারিতে স্টল সাজিয়ে নিজেদের সমাজ-সংস্কৃতিকে মেলে ধরেছে আমাদের কাছের দেশগুলোও৷ ভারত, চীন, জাপান, থাইল্যান্ডের স্টলগুলোও দৃষ্টি টেনে নেয়৷ এখানেই রয়েছে বাঙলার তথা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব৷বাংলাদেশের জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতি এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি এখানে স্টল দিয়েছে৷ অমিকন প্রকাশনীর রয়েছে আরেকটি স্টল৷ এদের মধ্যে রয়েছে ভারতীয় কিন্তু বাংলার প্রকাশনী সংস্থা আনন্দ পাবলিশার্স৷ পশ্চিমবঙ্গের এই প্রকাশনা সংস্থাটির প্রতিনিধ উজ্জ্বল কুমার সিনহা জানান, তারা ভারতীয় হলেও বাংলা ভাষার প্রকাশনা সংস্থা হওয়ায় ভারতীয়দের সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলোর কাছে তাদের জায়গা দেওয়া হয়েছে৷ তিনি জানান, প্রায় চার দশক ধরে প্রতিবছর এই বইমেলায় আসছেন তাঁরা৷ এরমধ্যে অনেকগুলো বইয়ের সত্ত্ব কিনে সেগুলো বাংলায় প্রকাশ করেছেন৷
আনন্দ পাবলিশার্সের স্টলে সাজানো বইগুলোর মধ্যে অলিম্পিকে অ্যাসটেরিক্স ও টিনটিন দেখিয়ে তিনি বলছিলেন, গতবার এই বইমেলায় আসল প্রকাশকের কাছ থেকে সত্ত্ব কিনে তা ছাপিয়েছেন তাঁরা৷ নিজেদের বাজারে বইগুলোর খুব কাটতির কথা জানালেন তিনি৷ এবার ফ্রান্স, ক্যানাডা ও চীনের কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁদের৷ চীনের প্রকাশনাটি ছোটদের বর্ণমালা পরিচিতির বই ছাপিয়েছে কাগজ নয়, কাপড়ে৷ ‘‘শিশুদের কাছে শিক্ষা আকর্ষণীয় করতে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, আসছে নতুন নতুন ধরন৷ এই বইমেলায় এসেই আমরা এগুলো সম্পর্কে জানতে পারি,'' বলেন তিনি৷
গত তিন বছর ধরে মেলায় অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশি প্রকাশনা সংস্থা অমিকন৷ এর প্রতিনিধি এহেসান মাহবুব বলেন, বিভিন্ন দেশের পাবলিশাররা এখানে আসেন৷ তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়, নতুন নতুন বই সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়৷ ‘‘তাই এই বইমেলা আমাদের কাছে খুবই স্পেশাল৷'' এখান থেকে গবেষণাধর্মী ও শিশু সাহিত্যের বইয়ের সত্ত্ব কিনে তা বাংলায় প্রকাশ করে নিজেদের সমৃদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন তিনি৷
জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির স্টলে কথা হয় ইউপিএল (ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড)-এর পরিচালক মাহরুখ মহীউদ্দিনের সঙ্গে৷ এবারই প্রথম মেলায় আসার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বৃহৎ পরিসরের এই মেলায় বাংলাদেশকে কীভাবে আরো ভালোভাবে উপস্থাপন করা যায়, সে ধারণা এবার নিয়ে যাচ্ছেন তিনি৷ এবার এই মেলার ফোকাসে ছিল জর্জিয়া৷ কোন কোন দিক বিবেচনায় দেশটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে বাংলাদেশকে এই জায়গায় নিতে করণীয় নির্ধারণে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সম্মিলিত প্রচেষ্টার কথা বলেন তিনি৷
এবারের বইমেলায় জার্মান প্রবাসী বাংলাদেশি কবি দীপঙ্কর দাশ গুপ্তের একটি কাব্য জার্মান ভাষায় প্রকাশ করেছে আর জে পাবলিশার্স নামের একটি প্রকাশনী সংস্থা৷ বাংলা সাহিত্যাঙ্গণে পরিচিত নাম অলোকরঞ্জন দাশ গুপ্তের ছোট ভাই দীপঙ্কর জানান, ‘শর্তবিহীন নষ্ট ভ্রমণ' নামের তাঁর এই কাব্যে ৫২টি কবিতা রয়েছে৷
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিকজায়গায় জায়গায় মঞ্চ বানিয়ে আলোচনা৷ ইন্টারন্যাশনাল স্টেজে বসে কবিতা, গল্প, উপন্যাস নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি নিজের দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন লেখক-বুদ্ধিজীবীরা৷
বইমেলায় দৃষ্টিনন্দন ছিল তরুণ-তরুণীদের যেমন ইচ্ছা তেমন সাজে নিজেকে উপস্থাপন৷ কেউ সেজেছেন বীর, কেউবা ভুত, কেউবা নিজের দেশের পতাকা অঙ্কিত পোশাকে ঢেকেছেন শরীর৷ বর্ণিল আর বৈচিত্র্যে ভরা তাঁদের সাজ-সজ্জা মন কাড়ে দর্শনার্থীদের৷ তাঁদের সঙ্গে ছবিও তুলতে দেখা যায় অনেককে৷