ভারতে শিশু যৌন নিপীড়নের বর্তমান অবস্থা
৩০ অক্টোবর ২০১৮চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ভারত উত্তাল হয়েছিল আট বছরের শিশু আসিফার ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে৷ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ, সমাবেশ হয়েছিল৷
কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, এর বেশ কিছু বছর আগে থেকেই ভারতে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে শিশু যৌন নির্যাতনের ঘটনা, যার কারণ হতে পারে ২০১২ সালের নতুন আইন৷
২০১২ সালের আগে যৌন নির্যাতনের শিকার হিসাবে শিশুদের জন্য কোনো বিশেষ আইন ছিল না৷ শুধু তাই নয়, যৌন নির্যাতনের বেশ কিছু ধরন, যা শিশু নির্যাতনের সমান, তার কোনো অন্তর্ভুক্তি তৎকালীন আইনে না থাকায় এ বিষয়ে পুলিশের তৎপরতাও ছিল কম৷
২০১২ সালের নভেম্বরে শিশু নির্যাতন আইন প্রণয়ন করা হলে দেখা যায় যে, শিশু ধর্ষণের প্রতিবেদনের সংখ্যা তার পরের বছরে প্রায় ৪৫ শতাংশ বেড়েছে৷ লিঙ্গ-নিরপেক্ষ এই নতুন আইনের আওতায় শিশু নির্যাতন ছাড়াও অন্যান্য ধরনের নির্যাতনও রয়েছে৷
বর্তমানে, ভারতে শিশু যৌন নির্যাতন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যার ঘটনা রিপোর্ট না করাও অপরাধতুল্য৷ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশু যৌন নির্যাতনের হার বর্তমানে যা অনুমান করা হচ্ছে, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি৷
২০০৭ সালে ভারতের নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রণালয় একটি জরিপ করেছিল, যেখানে ভারতের ১৩টি রাজ্যের সতেরো হাজারেরও বেশি শিশুর প্রতিক্রিয়া রেকর্ড করা হয়৷
জরিপে অংশগ্রহণকারী শিশুদের অর্ধেকেরও বেশি (৫৩ দশমিক ২ শতাংশ) জানায়, তারা এক বা একাধিকবার যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে৷
এশিয়ায় সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটসের ২০১৩ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ভারতে ৪৮,০০০ শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে৷ একই সময়ের মধ্যে আগের চেয়ে তিনগুণ বৃদ্ধি পায় শিশু ধর্ষণ৷
তবুও ভারতে শিশু নির্যাতনের বিষয়ে রয়েছে সামাজিক অস্বস্তি বা ‘ট্যাবু'৷ সাধারণ স্কুলে পড়া শিশুদের পাশাপাশি পথশিশু, বিশেষ প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মানো শিশু ও গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশু শ্রমিকেরা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে৷
নতুন আইন অনুসারে, শিশু যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিচার কাজ এক বছরের মধ্যে সম্পন্ন করা উচিত৷ কিন্তু আইনি প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ হওয়ায় তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘটে না৷
বিশেষ করে যেখানে অপরাধী হয় পরিবারের সদস্য বা শিশুর পরিচিত কোনো ব্যক্তি, অভিযোগ প্রত্যাহারের চাপ সে ক্ষেত্রে অনেক বেশি থাকে৷ পরিবারের সম্মান রক্ষার প্রশ্নে এমন অনেক অভিযোগ রয়ে যায় অলিখিত৷
যৌন শিক্ষার সাথে কলঙ্ক জড়িত থাকায় বাবা-মায়েরাও এ সম্পর্কে বাড়িতে কথা বলতে লজ্জা পান৷ পশ্চিমা দুনিয়ায় এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও ভারতের মতো দেশগুলোতে শিশুদের সাথে স্বাভাবিক যৌনক্রিয়া নিয়ে অভিভাবকেরা খোলাখুলিভাবে কথা বলেন না৷
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই বাধা কাটিয়ে উঠতে বাবা-মায়ের সাথে শিশুর সম্পর্ক হতে হবে বন্ধুর মতো, যাতে তারা নিজেদের সুরক্ষিত করতে শেখে৷ তাদের বোঝাতে হবে ‘খারাপ স্পর্শ' ও ‘খারাপ দৃষ্টি'-র সংজ্ঞা৷
সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি শিশু যৌন নির্যাতন, নিপীড়ন এবং ধর্ষণের জন্য ‘কঠোর শাস্তি' চেয়েছে৷ এতদিন শিশু ধর্ষণের আওতায় শুধু মেয়েরা থাকলেও ‘শিশু' শব্দটি পুনরায় সংজ্ঞায়িত করে তাতে ছেলেদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷
কিন্তু কেবলমাত্র আইন দিয়ে ঠেকানো যাবে না শিশুদের যৌন হয়রানি, যা ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে জ্বলন্ত সমস্যাগুলির অন্যতম৷
সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান – সর্বত্র ঘটতে থাকা শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হতে পারে সচেতনতা বৃদ্ধি৷ অপরাধী যেহেতু যে কেউ হতে পারে, সুতরাং প্রস্তুতিও হতে হবে সার্বিক ও সার্বক্ষণিক৷
বিভিন্ন বয়সের বাচ্চাদের জন্য প্রশিক্ষণ প্রণালী নির্ধারণ করা দরকার, যা শিক্ষকেরা স্কুলে শিশুদের এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ব্যবহার করতে পারেন৷ পাশাপাশি দরকার রাষ্ট্রের আইন বাস্তবায়ন ও সঠিক প্রচার৷ এই উদ্যোগের জন্য নাগরিক সমাজের সমর্থন ও ন্যায়বিচার, শিক্ষা, শিশু কল্যাণ বিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলিতে দৃঢ় কণ্ঠ প্রয়োজন৷
তবেই কমবে শিশুদের যৌন নির্যাতনের ঘটনা৷