ভারতে নির্বাচন জিততে ইশতাহার কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
১০ এপ্রিল ২০১৯দুই দলের ইশতাহারের মধ্যে সাদৃশ্য হলো, উভয়েই নাগরিকদের ‘নগদ' অর্থ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়েছে৷ কংগ্রেস, বিজেপির মতো অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলিও প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিচ্ছে৷
নতুন দিল্লির মসনদ দখলের এই লড়াইয়ে একদিকে বিজেপিকে চাপে রেখে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে কল্পতরু কংগ্রেস৷ অন্যদিকে, গত পাঁচ বছরের উন্নয়ন, রাম মন্দির নির্মাণ, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, নাগরিকপঞ্জি এবং সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫-এ ধারার অবলুপ্তিকে ফোকাস করেছে বিজেপি৷ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘হিন্দুত্ব' লাইন থেকে কিছুতেই সরছে না তারা৷
এখন প্রশ্ন, ৯০ কোটি ভোটারের কতজন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার আগে রাজনৈতিক দলগুলির ইশতাহার খতিয়ে দেখেন? আদৌ ভোটারের কাছে ইশতাহার পৌঁছয়?
অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘নানা মাধ্যমে ভোটারের কাছে ইশতাহার পৌঁছে যায়৷ অন্তত ইশতাহারের মূল বিষয়গুলি তো বটেই৷ রাজনৈতিক দলগুলির নেতারা মাঠে-ঘাটে যে সভা-সমিতি করেন তাতে দলীয় ইশতাহারের কথাই বেশি বলেন৷ তাছাড়া সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল এবং ইদানিং সোশাল সাইটের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক দলের ইশতাহারের মূল বিষয়গুলি জনতে পারেন৷'' তিনি উদাহরণ দেন, কংগ্রেস এবার ‘ন্যায়' প্রকল্পকে সামনে রেখে প্রচারে ঝাঁপিয়েছে৷ গ্রামে-গঞ্জে সেকথাই বলা হচ্ছে৷ একইভাবে বিজেপি নেতারাও তাদের মূল ইস্যুগুলি তুলে ধরছে৷
কিন্তু, ইশতাহারের প্রতিশ্রুতিগুলো কী বাস্তবায়িত হয়? জবাবে তিনি বললেন, ‘‘আশি-নব্বইয়ের দশকের পরিস্থিতি এখন আর নেই৷ এখন দলগুলি বুঝে গেছে প্রতিশ্রুতি পালন না করলে পরের বার ভুগতে হবে৷ যেমন নরেন্দ্র মোদীকে ‘কালোটাকা' ইস্যুতে খোঁচা সহ্য করতেই হচ্ছে৷ কংগ্রেস কর্মসংস্থান ও কৃষি নিয়ে যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে ক্ষমতায় এলে তাদের সেগুলি করে দেখাতেই মরিয়া হতে হবে৷''
ক'দিন আগে দলীয় প্রতীক ‘হাত'-এর পাঁচ আঙুল দেখিয়ে দলের নির্বাচনি ইশতাহার প্রকাশ করে ৫টি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন রাহুল গান্ধী৷ দারিদ্র, কৃষি, বেকারত্ব, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারী সুরক্ষা৷ ‘ন্যায়' প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ২০ শতাংশ দরিদ্রতম পরিবারকে বার্ষিক ৭২ হাজার টাকা পর্যন্ত আর্থিক অনুদানের কথা বলা হয়েছে৷ রাহুলের কথায়, ‘‘গত ৫ বছরে অনেক মিথ্যা প্রতিশ্রুতি শুনেছে দেশ৷ এবার তাদের সমস্ত প্রতিশ্রুতি পালন করে দেখাবে কংগ্রেস৷'' প্রশ্ন ছিল, বিজেপি'র হিন্দুত্ব ও দেশপ্রেম - এইসব ইস্যুর মোকাবিলা কীভাবে করবেন? রাহুলের জবাব, ‘‘এই ধরণের বিভিন্ন ইস্যুর আড়ালে লুকোতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ কিন্তু, উনি শত চেষ্টা করলেও পালাতে পারবেন না৷ আমরা ওঁকে হারাবই৷''
অন্যদিকে, ভারতীয় জনতা পার্টির ইশতাহারে ছত্রে ছত্রে তুলে ধরা হয়েছে জাতীয়তাবাদ, হিন্দুত্ব ও গত ৫ বছরের উন্নয়নকে৷ তাদের থিম ‘সংকল্পিত ভারত, সশক্ত ভারত'৷ গত বাজেটে নরেন্দ্র মোদী সরকার ঘোষণা করেছিল, ২ হেক্টরের কম কৃষি জমির মালিকদের বছরে ৬ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হবে৷ এবার ইশতাহারে আরও একধাপ এগিয়ে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় এলে জমির উর্ধ্বসীমা নয়, এবার সমস্ত কৃষককে বছরে ৬ হাজার টাকা দেবে মোদী সরকার৷ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের ৬০ বছর বয়সের পর পেনশন দেওয়া হবে৷ এক লক্ষ পর্যন্ত কৃষিঋণ হবে সুদহীন৷ ২০২২-এর মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুন করার প্রতিশ্রুতি আরও একবার উল্লেখ করা হয়েছে৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষক দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরি বলছেন, ‘‘নির্বাচনি ইশতাহার অনেক সময় দলের কর্মীরাই পড়ে দেখেন না৷ এ ব্যাপারে একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা বোঝা যাবে৷ উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি ও রাষ্ট্রীয় লোকদলের মধ্যে ‘মহাজোট' হয়েছে৷ কংগ্রেসের ইশতাহার প্রকাশের কয়েকদিন পর আরএলডি প্রধান তথা মুজফ্ফরনগরের প্রার্থী চৌধুরি অজিত সিংকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কংগ্রেসের ইশতাহারে কী আছে? তিনি জবাব দিয়েছেন, তিনি ইশতাহার পড়েননি৷ ভারতে এবার সাধারণ নির্বাচন হবে নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে ও বিপক্ষে৷ মোদীর বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই হতে চলেছে৷''
ইশতাহারে কংগ্রেস দাবি করেছে, তারা ক্ষমতায় এলে প্রস্তুত হবে পৃথক কৃষি বাজেট৷ বোঝাই যাচ্ছে, অন্যান্য বারের মতো কৃষি ও কৃষক এবার নির্বাচনের বড় বিষয়৷ কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়েছে কংগ্রেসের ইশতাহারে৷ মোদীকে কটাক্ষ করে তাঁর ‘বছরে দু কোটি চাকরি'র কথা স্মরণ করিয়েছে কংগ্রেস৷ রাহুলের দাবি, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে প্রথম বছরেই সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ২২ লক্ষ শূন্যপদ পূরণ করা হবে৷ সেইসঙ্গে পঞ্চায়েতে আরও ১০ লক্ষ কর্মসংস্থান হবে৷ যুবারা ‘স্টার্ট আপ' ব্যবসা খুলতে চাইলে প্রথম ৩ বছর কোথাও কোনো অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন হবে না৷ এছাড়া মনমোহন সিং জমানার ‘মনরেগা' প্রকল্পে ১০০ দিনের কাজ বাড়িয়ে ১৫০ দিন করা হবে৷
ওদিকে, দেশের উত্তর-পূর্বে নাগরিকত্ব বিল ও নাগরিকপঞ্জি দুই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷ নাগরিকত্ব বিল বিষয়ে অসম-সহ উত্তপূর্বের রাজ্যগুলিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে৷ বিপুল সংখ্যক মানুষের নাগরিকত্বের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে৷ নাগরিকপঞ্জির তীব্র বিরোধিতা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷