ভারতে আদিবাসীদের মাথায় উত্খাতের খাঁড়া ঝুলছে
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯২০০৬ সালের বনভূমি অধিকার রক্ষা আইনে বলা হয়েছে, জঙ্গল বা তার ধারে কাছে বসবাসকারী পরিবারগুলিকে জমির মালিক হিসেবেই গণ্য করা হবে৷ কিন্তু সরকারি নিষ্ক্রিয়তায় সেই সংক্রান্ত নথিপত্র দেখাতে পারেননি বনবাসীরা৷
অন্তত ১৭টি রাজ্য থেকে ১০ লাখেরও বেশি বনবাসী উপজাতি ও অন্যান্য জনজাতি পরিবারগুলিকে উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট৷ ২০০৬ সালের অরণ্য অধিকার আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কিছু অরণ্যপ্রেমী সংগঠনের দায়ের করা জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে এই নির্দেশ৷
আইনে কী ছিল?
আইনে বলা হয়েছে, যে-সব উপজাতি পরিবার বংশপরম্পরায় অরণ্যভূমিতে বসবাস করছে, চাষাবাদ করছে এবং সেখান থেকেই তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করছে সেখানে তাঁদের থাকার অধিকার আছে৷ আইন প্রণয়নের দিন পর্যন্ত বনবাসীরা যে যেখানে বাস করছেন, তিনি বা তাঁরা জমির মালিক বলে গণ্য হবেন৷
কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকার নানা অজুহাতে জমির মালিকানাপত্র, যাকে পাট্টা বলে, তা দিতে গড়িমসি করে৷
ফলে নিরক্ষর বনবাসী পরিবারগুলির পক্ষে ঐ সংক্রান্ত নথিপত্র জোগাড় করা সম্ভব না হওয়ায় তাঁদের জমির মালিকানাসত্ত্ব খারিজ হয়ে যায়৷
এর জেরে ১৭টি রাজ্যের এই রকম ১০ লাখেরও বেশি জনজাতি পরিবার, যারা জমির পাট্টা জোগাড় করতে পারেনি, কিংবা পাট্টার আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়া পরিবারগুলিকে ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে উত্খাত করার নির্দেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত৷
উচ্ছেদের বিষয়ে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা জানাতে সরকারকে আদালত নোটিশ দিয়েছে৷
প্রতিক্রিয়া
বিভিন্ন আদিবাসী অধিকার রক্ষা গোষ্ঠীগুলির অভিযোগ, চূড়ান্ত শুনানির দিনে তাঁদের পক্ষ হয়ে কথা বলার জন্য সরকারের তরফে কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না৷ তাঁদের সমস্যার বিহিত করতে গোড়া থেকেই সরকার উদাসীন৷ ফলে ২০০৬ সালের জনজাতি গোষ্ঠীগুলির অরণ্যের অধিকার আইনের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়৷ তাঁদের বংশানুক্রমিক আবাসভূমি থেকে আজ তাঁরা উচ্ছেদের সন্মুখীন৷
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি মোদী সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চায়৷ কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী মনে করেন, এই বিষয়ে মোদী সরকার আগাগোড়া নীরব দর্শক হয়ে থাকেন৷ এতে বোঝা যায়, আদিবাসী ও জনজাতিদের প্রতি সরকার কতটা নির্বিকার৷ লক্ষ লক্ষ গরিব আদিবাসী কৃষিজীবী পরিবার তাদের চিরাচরিত বাসভূমি থেকে উত্খাত হলে মোদী সরকারের কিছু যায় আসে না৷ ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, জল, জঙ্গল ও জমি আদিবাসীদের জীবনধারণের এক অঙ্গ৷ কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যগুলিকে এই মর্মে চিঠিও দিয়েছেন রাহুল গান্ধী৷
এদিকে, কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট) বা সিপিআই-এম তরফে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের প্রেক্ষিতে মোদী সরকারের উচিত অবিলম্বে অর্ডিন্যান্স জারি করে আদিবাসীদের চিরাচরিত অরণ্য বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ আটকানো৷ আদালতের নির্দেশে তাঁরা বিনাদোষে শাস্তি পাবে৷ এজন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি সমান দায়ী৷ মোদী সরকার আগেই বনভূমির অধিকার রক্ষা আইন শিথিল করেছিল৷
উল্লেখ্য, ভারতে প্রায় চার কোটি হেক্টর বনভূমিতে বসবাস করে প্রায় ১০ কোটি আদিবাসী ও অন্যান্য জনজাতি৷ এদের উচ্ছেদ করার পেছনে আপাত কারণ হলো, খনি ও কলকারখানার জন্য আরো জমি চাই৷ জীববৈচিত্র্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিল্পোদ্যোগীদের হাতে জমি তুলে দেওয়া চাই৷ ঝাড়খন্ডে কয়েক হাজার বনভূমি এলাকা দখল করে নিয়েছে আদানি কোম্পানি৷ তাদের হয়ে প্রমাণ ও পুলিশ দুই-ই জুগিয়েছে সরকার৷ এই রকমভাবে আদিবাসীদের বনভূমি আবাস কেড়ে নিয়ে খনি হয়েছে, বাঁধ হয়েছে, কারখানা হয়েছে৷ তাঁরা পেয়েছে শুধু অবিচার আর বঞ্চনা৷
নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সুপ্রিম কোর্ট এই আদেশ দিলেন৷ এর আগে কয়েকটি রাজ্যের ভোটের ফলাফলে বিজেপির বিরুদ্ধে আদিবাসীদের ক্ষোভ প্রতিফলিত হয়েছিল৷ কারণ আদিবাসী ও অন্যান্য জনজাতিরা ভোটের একটা বড় অংশ৷ আগামী সাধারণ নির্বাচনে তার অভিঘাত পড়বে না, কে বলতে পারে? সম্ভবত ভোটের দিকে তাকিয়ে বিজেপি এবং কংগ্রেস সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ পুনর্বিবেচনা করার আর্জি জানাবে এমনটাই বলা হচ্ছে৷