ভারতে আজও মানুষ মরছে অনাহারে!
১ ডিসেম্বর ২০১৮মাস দুয়েক আগে গত সেপ্টেম্বরের গোড়ায় ভারতে ধুমধাম করে পালিত হলো ‘জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ'৷ সরকারি অনুষ্ঠানে প্রচারিত হলো অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা৷ কিন্তু সেসব কথার কথা৷ বাস্তবে আজও ভারত জুড়ে অনাহারে মৃত্যুর সংবাদ আসছে অহরহ৷ এমনকি রাজধানী দিল্লি, পার্শ্ববর্তী উত্তরপ্রদেশ অথবা ওড়িশা, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য থেকে সংবাদ শিরোনামে উঠে আসছে অনাহার ও অপুষ্টিতে মৃত্যুর ঘটনা৷
সম্প্রতি এক জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে অনাহার ও অপুষ্টিজনিত মৃত্যু প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে চেয়ে কেন্দ্র সরকার ও দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়াল সরকারকে নোটিশ পাঠিয়েছে দিল্লি হাইকোর্ট৷ জানতে চাওয়া হয়েছে এই ধরনের ঘটনা বন্ধ করতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷
দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি রাজেন্দ্র মেনন এবং বিচারপতি ভি কে রাওয়ের বেঞ্চে শুনানি হবে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি৷ মামলায় দাবি করা হয়েছে, বিশেষত বস্তি ও ঝুপড়িবাসীদের মধ্যে অনাহার ও অপুষ্টির কারণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে৷ সরকারি নিয়মে রেশন কার্ড ধারকদের ভর্তুকি দরে খাদ্যশষ্য দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে৷ কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে বস্তি, ঝুপড়ি ও ফুটপাথবাসীদের অনেকের কাছেই রেশন কার্ডটুকুও নেই!
এখন প্রশ্ন, কেন রেশন কার্ড নেই? নানা সমীক্ষায় উঠে এসেছে, দেশের নানা প্রান্ত থেকে দিল্লির মতো বড় শহরগুলিতে বসবাসকারী অত্যন্ত গরিব মানুষদের কাছে স্থানীয় এলাকায় বসবাসের গ্রহনযোগ্য প্রমাণপত্র নেই৷ প্রমাণপত্র না থাকলে রেশন কার্ড দেওয়ার নিয়ম নেই৷ অতএব, রেশনে স্বল্পমূল্যে খাদ্যশষ্য থেকে বঞ্চিত হন এইসব মানুষ৷ জনৈক আইনজীবী মণীশ পাঠক তাঁর মামলায় অভিযোগ তুলেছেন, দেশের নির্বাচিত সরকার আইন করে খাদ্য সুরক্ষা আইন চালু করেছে৷ কিন্তু শর্তসাপেক্ষে খাদ্য সুরক্ষা বস্তুত সংবিধানপ্রদত্ত নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করার শামিল৷ এই মামলাটি প্রথমে সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা হয়েছিল৷ দেশের সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দেয়, আগে দিল্লি হাইকোর্টে আপিল করতে হবে৷ মামলায় দাবি করা হয়েছে, সমাজের প্রান্তিক মানুষের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টিকর খাদ্য ও পানীয় জল পৌঁছে দিতে সঠিক ও উপযুক্ত নীতি নির্ধারণ করুক সরকার৷ আরো আর্জি, গরিব মানুষদের বিনামূল্যে, নিঃশর্তে খাদ্যবস্তু বিতরণের জন্য দক্ষ গণবন্টন ব্যবস্থা প্রণয়ন করার নির্দেশ দিক আদালত৷ বিচারপতিরা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের পাশাপাশি এই মামলায় যুক্ত হওয়ার জন্য দিল্লি সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দফতর, সমাজ কল্যাণ দফতর এবং মহিলা ও শিশু কল্যাণ দফতরকে নির্দেশ দিয়েছেন৷
বস্তিবাসীদের একটা বড় অংশের রেশনকার্ড না থাকায় তাঁরা ভর্তুকির খাদ্যদ্রব্য থেকে বঞ্চিত হন৷ এ কারণে এসব এলাকায় অপুষ্টি এবং অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে৷
পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম দক্ষিণ-পশ্চিম দিল্লির কয়েকটি বস্তি এলাকায়৷ অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অভিযোগ অনেকাংশেই সত্য৷ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ভোটবাক্সের লোভ বেশকিছু বস্তিবাসীর হাতে রেশনকার্ড, আধারকার্ড পৌঁছে দিয়েছে৷ কিন্তু ফুটপাথবাসীদের কারো কাছেই সরকারি কোনো প্রমাণপত্র নেই৷ স্বভাবতই তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন ভর্তুকির খাদ্যশষ্য থেকে৷ সাগরপুর এলাকায় বড় রাস্তার পাশে অস্থায়ী তাঁবুতে বসবাস করেন পান্নালাল৷ বাবা-মা, স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে মোট ১২ জনের সংসার তাঁর৷ পেশা ভিক্ষা৷ পান্নালালের স্ত্রী কবিতা জানালেন, ‘‘যেদিন কিছু টাকা-পয়সা জোটে, সেদিন সবাই মিলে আধপেটা খাবার খাই৷ যেদিন ভিক্ষা জোটে না, সেদিন ভরসা শুধুই জল৷''
প্রসঙ্গত, গত জুলাইয়ে এই দিল্লিতেই অনাহারে একসঙ্গে ৩ শিশুকন্যার মৃত্যুর ঘটনা সামনে এসেছিল৷ টানা আটদিন ধরে অভুক্ত ছিল ২, ৪ ও ৮ বছরের ওই শিশুরা৷ পূর্ব দিল্লির মান্ডাওয়ালি এলাকার ঘটনা৷ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে মা-এর কাছে শিশুদের আর্তি ছিল, ‘‘মা খেতে দাও৷''
ওই ঘটনার সমাধান তেমন কিছু না হলেও শিশুমৃত্যু নিয়ে রাজনীতির খেলায় মেতে উঠেছিল রাজনৈতিক পক্ষগুলি৷ আম আদমি পার্টি, ভারতীয় জনতা পার্টি এবং কংগ্রেসের নেতারা একে অপরের ঘাড়ে দোষা চাপানোর পালা আজও চালিয়ে যাচ্ছেন৷
এমন ঘটনা ঘটেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-শাসিত পশ্চিমবঙ্গেও৷ ঝাড়গ্রাম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বসবাস করেন আদিবাসী জনজাতি লোধা-শবররা৷ তুলনায় ধনীদের চাষের জমিতে দিনমজুর খেটে অথবা স্থানীয় জঙ্গল থেকে কাঠকুটো কুড়িয়ে জীবনযাপন করেন তাঁরা৷ সন্তানসন্ততিদের স্কুল, লেখাপড়া নেই বললেই চলে৷ ক'দিন আগে জঙ্গলমহলের লালগড়ে পূর্ণাপানিতে অনাহারে ৭ জন শবরের মৃত্যুর খবর প্রকাশ করেছে এক দৈনিক৷ অভিযোগ– এই এলাকায় অনাহার ও অপুষ্টির কারণে মৃত্যু হয়েছে মঙ্গল শবর (২৮), কিসান শবর (৩৪), লেবু শবর (৪৬), সুধীর শবর (৬৩), সাবিত্রী শবর (৫১), পল্টু শবর (৩৩) ও লাল্টু শবরের (৩৮), যা মানতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা৷ কিছুদিন আগেই একই ধরনের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে উত্তরপ্রদেশের কুশীনগরের মুশাহররা থেকে৷ গত সেপ্টেম্বরেই সেখানে খেতে না পেয়ে মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের, যদিও সরকারি হিসেব তা মানতে চায়নি৷ মহাদলিত মুসাহর সম্প্রদায়ের প্রধান খাদ্য ইঁদুরের মাংস৷ মূলত স্বাভাবিক খাদ্যবস্তুর অভাবে ইঁদুর খেতে বাধ্য হন তাঁরা৷ সবার রেশনকার্ড নেই৷ ৫ জনের মত্যুর পর বস্তা ভরে খাদ্যশষ্য পাঠিয়েছে সরকার৷