ভারতের উন্নয়ন মডেল কি গ্রহণযোগ্য?
১৭ মে ২০১৫বিশ্ব অর্থনীতি তথা ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের ধারাবাহিকতার সঙ্গে যে তাল মিলিয়ে চলার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে ভারতের নরেন্দ্র মোদী সরকার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ দেশে-বিদেশে ভারতের সেই ক্যানভাসটাই নিপুণ মার্কেটিং দক্ষতায় তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং৷ নরেন্দ্র মোদীর দোস্তিকে ইতিমধ্যে দু'হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানিয়েছেন বিশ্বের তাবড় তাবড় নেতারা৷
প্রশ্ন হচ্ছে, সেই ছবিটার বাস্তবায়ন কি হচ্ছে? হলে কতটা? আমার তো মনে হয়, ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের ১২৪ কোটি জনসংখ্যার দেশে যতটা বলা হচ্ছে, ততটা করে দেখানো সহজ নয়৷ বিশেষ করে, ভারতের মতো বহু জাতি বহুমতের গণতন্ত্রে যেখানে তিন পা এগোলে দু'পা পিছিয়ে আসাটাই দস্তুর৷ দ্বিতীয়ত, গোটা বিশ্বের উন্নয়নের সঙ্গে এখন গভীরভাবে সম্পৃক্ত পরিবেশ, কার্বন নির্গমন৷ উন্নত দেশগুলির মতে, দরকার হলে পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে উন্নতিকামী দেশগুলিকে উন্নয়নে কাটছাঁট করতে হবে৷ এর প্রত্যক্ষ অভিঘাত ভারতের মতো উন্নয়নমুখী দেশগুলির ওপর কতটা, এই মুহূর্তে সেটা বহু-চর্চিত একটা ইস্যু৷ অবশ্যই একটা বিতর্কিত ইস্যু৷ পরিবেশের রক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করেও আমার মতো কেউ কেউ মনে করে, উন্নত দেশগুলি কিন্তু তাদের শিল্পায়নে রাশ টানেনি৷ কিয়োটো প্রোটোকল নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে৷ কাজেই সেদিক থেকে মোদী কি উন্নত দেশগুলির সঙ্গে সমান তালে পা মিলিয়ে চলতে পারবেন?
প্রধানমন্ত্রী মোদীর বিজেপি দল ক্ষমতাসীন হবার পর এ নিয়ে নানা মহলে নানা মত৷ প্রশ্ন উঠেছে, মোদীর ‘আচ্ছা দিন'-এর প্রতিশ্রুতি কি নেহাতই স্লোগান সর্বস্ব? তাছাড়া যে স্লোগান দিয়ে মোদী জমানা শুরু হয়েছে, তা বাস্তবায়িত করতে মোদী কতটা তত্পর? আমার তো মনে হয়, মূল প্রশ্নটা ঠিক তা নয়৷ মোদী সরকার অনেক ভালো ভালো অর্থনৈতিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে, অর্থনৈতিক সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছে, জোর গলায় কেন্দ্র-রাজ্য সহযোগিতা তথা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর জোর দিয়েছেন, বৈদেশিক নীতিতেও ভুবনায়নের অনেক খোলা বইছে৷ অনেক খোলা মন নিয়ে বৈশ্বিক পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ভারতকে মেলাতে চেয়েছেন৷
তা সত্ত্বেও বাস্তব প্রতিফলনের নিরিখে বিচার করলে তার নিট ফল আশানুরূপ হয়েছে বলে অন্তত আমার মনে হয় না, অন্তত এখনো পর্যন্ত৷ কেন হয়নি তার আপাত কারণ সরকারের ‘আচ্ছা দিন'-এর সদিচ্ছার অনেকটাই আমলাতান্ত্রিক স্তরে গিয়ে খেই পাচ্ছে না৷ কিংবা বলা যায়, প্রশাসনিক জঙ্গলে হারিয়ে যাচ্ছে৷ সেটাকে মুঠোয় আনতে মোদীর এখনো সময় লাগবে৷ অথচ এমনটা হবার কথা নয়, অন্তত রাজনৈতিক স্তরে৷ সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে মোদী সরকারের৷ প্রতি পদে অন্য দলের সমর্থনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না৷ যে কারণে সাবেক মনমোহন সিং-এর কংগ্রেস জোট সরকারকে নীতি রূপায়ণে পদে পদে ঠোক্কর খেতে হয়েছিল৷ দ্বিতীয়ত, মোদী সরকারের আগ্রাসী সাংস্কৃতিক নীতিও এ জন্য আংশিক দায়ী৷ এই নীতি দেশকে বিভাজনের দিকে ঠেলে দিয়েছে৷
তবে হ্যাঁ, দেশের আর্থিক স্বাস্থ্যে কিছুটা হলেও অক্সিজেন জোগাতে পেরেছেন মোদী সন্দেহ নেই৷ আর্থিক প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে হয়েছে সাত শতাংশের ওপরে৷ দ্বিতীয় বড় ইতিবাচক ইঙ্গিত মুদ্রাস্ফীতির হার নেমে এসেছে পাঁচ শতাংশে৷ এখানেও পুরো কৃতিত্ব আমি দিতে পারছি না মোদী সরকারকে৷ এটা অনেকটাই হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম পড়ে যাওয়ায়৷ মোটা বিদেশি লগ্নি এখনো মোদী টানতে পারেননি৷ কর সংস্কারে হাত দিতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছেন৷ শেয়ার বাজারে লেনদেনকারী বিদেশি লগ্নিকারী সংস্থাগুলির পুরনো মুনাফার ওপর কর চাপাতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়েছে৷ বিদেশি লগ্নিকারী সংস্থাগুলি শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে৷ অন্যদিকে পরিকাঠামো উন্নয়ন তথা শিল্পায়নে ‘মেক-ইন-ইন্ডিয়া' নীতির রোডম্যাপ কার্যকর করতে গিয়ে সংসদে জমি অধিগ্রহণ বিল এবং পণ্য ও পরিষেবা কর বিল পাশ করাতে হিমশিম খাচ্ছে মোদী সরকার, যেহেতু সংসদের উচ্চকক্ষে সরকার পক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই৷ খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ নীতিও ফাইলবন্দি৷ এক কথায় সার্বিক আর্থিক সংস্কারে মোদী সরকারের এখন ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা৷
উপসংহারে বলা যায়, এ সব সত্ত্বেও বর্তমান বিশ্বে ভারতের বিশাল বাজারকে কোনো দেশই অস্বীকার করতে পারে না৷ আর্থিক সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে মোদী আগামী চার বছরে সেটাকে কাজে লাগাতে পারবেন বলে আশা করা যায়৷ যদি পারেন, তাহলে মোদী উচ্ছ্বাস আবার ফিরে আসবে৷ সফল হবে ভারতের বিশ্বায়নের ধারাবাহিকতা৷