ভারতীয় শাসনে আয়ারল্যান্ডের আত্মসমর্পণ
৫ জুন ২০২৪আয়ারল্যান্ডের ৯৬ রানের চ্যালেঞ্জ ভারত পেরিয়ে যায় ৪৬ বল ও ৮ উইকেটে হাতে রেখে৷ ৬ রানে ২ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা জাসপ্রিত বুমরা৷ রোহিত শর্মা ৫২ রান করে হন রিটায়ার্ড হার্ট৷
নিউইয়র্কের নাসাউ কাউন্টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম এমনিতেই অপার বিস্ময়ের নাম৷ ক্রিকেটের প্রথম ‘মডিউলার' স্টেডিয়াম তৈরি হয়েছে কেবল পাঁচ মাসে, যা দেখে মুগ্ধতা ঝড়েছিল রোহিত শর্মার কণ্ঠে৷ তবে ১৪ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আনা ড্রপ ইন পিচ দেখে মুগ্ধতার বদলে ছিল ধোঁয়াশা৷
৪৫০টির বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মা আয়ারল্যান্ডের মুখোমুখি হওয়ার আগের দিন বলেছিলেন, ‘‘এখানকার পিচ, পরিবেশ, আউটফিল্ড কেমন হবে জানি না৷ মনে হয় ১৫০ রান খারাপ স্কোর নয়৷ তবে শেষ পর্যন্ত কোনটা ভালো স্কোর জানি না!''
রহস্যময় পিচে শ্রীলঙ্কা মাত্র ৭৭ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে৷ জবাবে প্রোটিয়াদের ম্যাচ জিততে খেলতে হয় ১৬.২ ওভার পর্যন্ত৷ তবে শ্রীলঙ্কার খেলা চার নম্বর পিচের বদলে ভারত-আয়ারল্যান্ড ম্যাচটা হয় এক নম্বর পিচে৷ এখানেই বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ১৮০ রান করেছিল ভারত৷
সেই উইকেটে ঝুঁকি না নিয়ে টস জিতে বোলিং নেন রোহিত শর্মা৷ দলের চার পেসার জাসপ্রিত বুমরা, মোহাম্মদ সিরাজ, অর্শদীপ সিং ও হার্দিক পান্ডিয়া এনে দেন দাপুটে শুরু৷ পাওয়ার প্লের ছয় ওভারে দুই উইকেটে মাত্র ২৬ রান করেছিল আয়ারল্যান্ড, যা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তাদের সর্বনিম্ন৷ আগের সর্বনিম্ন ছিল ২০১২ সালে কলম্বোয় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩ উইকেটে ২৯৷ শুরুর এই চাপটা আর কাটাতে না পেরে আইরিশরা ১৬ ওভারে গুটিয়ে যায় ৯৬ রানে৷
পিচ কঠিন হলেও অল্প রানের লক্ষ্যটা দুই উইকেট হারিয়ে ৪৬ বল হাতে রেখে পেরিয়ে যায় ভারত৷ রোহিত শর্মা ৩৭ বলে ৫২ ও ঋষভ পন্ত খেলেন ২৬ বলে অপরাজিত ৩৬ রানের ইনিংস৷ দ্বিতীয় উইকেটে দুজন গড়েন ৫৪ রানের জুটি৷
নতুন বলটা জাসপ্রিত বুমরার জায়গায় রোহিত শর্মা তুলে দেন অর্শদীপ সিংয়ে হাতে৷ ধারাভাষ্যে তখন নিজের বিস্ময় জানাচ্ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক রিকি পন্টিং৷ দ্বিতীয় ওভারটা করেন মোহাম্মদ সিরাজ৷ বুমরা আক্রমণে আসেন ষষ্ঠ ওভারে৷
পন্টিং বিস্মিত হলেও আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন অর্শদীপ৷ প্রথম ওভারে তার খরচ তিন রান৷ আর নিজের দ্বিতীয় ওভারে ফেরান আইরিশ অধিনায়ক পল স্টার্লিং ও অ্যান্ড্রু বালবির্নিকে৷ অন সাইডে পরা লেন্থ বলটা আকাশে তুলে দেন স্টার্লিং (২ রান)৷ বুমরা প্রথমে কল করলেও তাকে থামিয়ে ক্যাচ তালুবন্দি করেন উইকেটরক্ষক ঋষভ পন্ত৷ সেই ওভারের ষষ্ঠ বলের অ্যাঙ্গেলে বিভ্রান্ত হয়ে বোল্ড বালবির্নি (৫)৷ বলটা নিচুও হয়েছিল কিছুটা৷
নিজের তৃতীয় ওভারটা অবশ্য এলোমেলো করেছিলেন অর্শদীপ৷ সেই ওভারে আসে ১৩ রান, এর ৮টি ওয়াইড থেকে! ইনসুইং করতে যেয়ে দ্বিতীয় বলটা বাউন্ডারিতে যায় পন্তকে কোনও সুযোগ না দিয়ে (৫) রান৷ সেই ওভারে আরও ৩টি ওয়াইড করেন তিনি৷ অর্শদীপের প্রথম স্পেল শেষ হয় ৩ ওভারে ১৮ রানে ২ উইকেটে৷
পাওয়ার প্লের শেষ ওভারটা করেন বুমরা, যা ছিল মেডেন৷ সপ্তম ওভারে আক্রমণে এসে পঞ্চম বলে লরকান টাকারকে (১০) বোল্ড করেন হার্দিক পান্ডিয়া৷ কভারে শট খেলা টাকার বোল্ড হন বলের লেট মুভমেন্টে৷ এরপর টানা ৪ ওভারে ৪ উইকেট হারায় আয়ারল্যান্ড৷
বিরাট কোহলির ক্যাচ বানিয়ে ১৬ বলে মাত্র ৪ রান করা হ্যারি টেক্টরকে ফেরান বুমরা৷ তার বাউন্সার গ্লোভসে লেগে গিয়েছিল কভারে৷ হার্দিকের পরের ওভারে কার্টিস ক্যাম্পফার (১২) ক্যাচ দেন উইকেটের পেছনে পন্তকে৷ মার্ক অ্যাডায়ারকেও (৩) ফেরান হার্দিক৷ টানা দুই বলে দুই উইকেট নিলেও শেষ পর্যন্ত হ্যাটট্রিক হয়নি তার৷
নড়বড়ে ব্যাটিংয়ে বিধ্বস্ত হওয়া আয়ারল্যান্ডের হয়ে পাল্টা প্রতিরোধ গড়েছিলেন গ্যারেথ ডিলানি৷ ১৪ বলে ২ বাউন্ডারি ২ ছক্কায় ২৬ করেন তিনি৷ তবে রানআউট হয়ে ফেরেন তিনি, তাও নো বলে ফ্রিহিটে দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে!
৪ ওভারে ২৭ রানে ৩ উইকেট নেন হার্দিক৷ বুমরা ৩ ওভারে মাত্র ৬ রানে ২ উইকেট নিয়ে হন ম্যাচসেরা৷ অর্শদীপ ৪ ওভারে ৩৫ রানে ২টি ও মোহাম্মদ সিরাজ ৩ ওভারে ১৩ রানে নেন ১ উইকেট৷ অপর উইকেটটি অক্ষর প্যাটেলের৷ ভারতীয় পেসাররা ম্যাচে নিয়েছেন ৮ উইকেট৷ এর আগে ২০০৭ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯টি আর ২০২২-এ সেই পাকিস্তানের সঙ্গেই ৮ উইকেট নিয়েছিলেন ভারতীয় পেসাররা৷
ড্রপ ইন পিচে শুরুতে ঘাসের একটা অতিরিক্ত স্তর থাকে৷ এরকম পিচে কিছুদিন ক্রিকেট খেলার পরই সেটা ব্যাট করার জন্য আদর্শ হয়ে ওঠে৷ সেই খেলাটাই হয়নি এখানে৷ এজন্য বাড়তি সুবিধা পেয়েছেন পেসাররা, আইরিশ ব্যাটাররা যা সামলাতে পারেননি৷
ভারতীয় সাবেক ক্রিকেটার সঞ্জয় মাঞ্জেরেকার ম্যাচের আগেই অসন্তুষ্টি জানিয়েছিলেন পিচ নিয়ে, ‘‘৮০র দশকের পিচ আর ২০২০ সালের ব্যাটার৷ খুব একটা জমল না৷'' ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী অলরাউন্ডার ইরফান পাঠান সরাসরিই বলেছেন, ‘‘এটা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আদর্শ পিচ নয়৷''
সেই পিচে মার্ক অ্যাডায়ারের করা প্রথম ওভারেই জীবন পান রোহিত শর্মা৷ দ্বিতীয় স্লিপে তার ক্যাচ ছাড়েন অ্যান্ড্রু বালবির্নি৷ জশ লিটলের বলে ইনসাইড এজ হয়ে পেয়েছিলেন বাউন্ডারি৷ সেই আড়ষ্টতা কাটিয়ে ৩৭ বলে ৪ বাউন্ডারি ৩ ছক্কায় খেলেন ৫২ রানের ইনিংস৷ তবে শটগুলো ঝকঝকে ছিল না৷ কখনও টাইমিং হয়নি, কখনও বল উঠেছে আকাশে তো কখনও লেগেছে শরীরে৷ একবার বল বাহুতে লাগায় দশম ওভার শেষে মাঠ ছেড়ে যান রোহিত৷ পরের ম্যাচ পাকিস্তানের সঙ্গে হওয়ায় ঝুঁকি নেননি ভারতীয় অধিনায়ক৷
টি-টোয়েন্টিতে এটা রোহিতের ৩০তম ফিফটি৷ ইনিংসটির পথে বিরাট কোহলির পর দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে তিন ফরম্যাটেই পা রাখেন ৪ হাজার বা বেশি রানের মাইলফলকে৷
২০২১ সালের পর প্রথমবার আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ওপেন করতে নেমেছিলেন বিরাট কোহলি৷ এবারের আইপিএলে সবচেয়ে বেশি রান করা কোহলির বিশ্বকাপে রান তাড়ায় খেলা ইনিংসগুলো ৭৮*, ৩৬*, ৫৪, ৫৭, ৭২*, ২৩, ৫৫*, ৮২*, ২ ও ৮২*৷ তবে ওপেনিংয়ে ফেরাটা স্মরণীয় হলো না তার৷ ফেরেন ৫ বলে ১ রানে৷ মার্ক অ্যাডায়ারের শর্ট বল লাফিয়ে উঠেছিল কিছুটা যা কোহলির ব্যাটে লেগে যায় থার্ডম্যানে দাঁড়ানো বেনজামিন হোয়াইটের হাতে৷
ওয়ান ডাউনে ব্রায়ান লারার মত কিংবদন্তি দেখতে চেয়েছিলেন সূর্যকুমার যাদবকে৷ তবে ডান হাতি-বাম হাতি কম্বিনেশনের জন্য ভারত নামায় জীবন যুদ্ধে জয়ী ঋষভ পন্তকে৷ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে গাড়ি দুর্ঘটনায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলে যাওয়া পন্ত খেলেন ২৬ বলে ৩ বাউন্ডারি ২ ছক্কায় হার না মানা ৩৬ রানের ইনিংস৷
কঠিন পিচেও শুরু থেকে স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন এই উইকেটকিটপার ব্যাটসম্যান৷ তবে জশ লিটলের করা ১১তম ওভারে দুবার শরীরে বল লাগে ঋষভের৷ ধাক্কাটা কাটিয়ে ব্যারি ম্যাকার্থির বলে রিভার্স স্কুপে ছক্কা মেরে ১৩তম ওভারে ভারতের জয় নিশ্চিত করেন তিনি৷
চার নম্বরে নামা সূর্যকুমার যাদব সুবিধা করতে পারেননি অবশ্য৷ বেন হোয়াইটের বলে মিডউইকেটের উপর দিয়ে ছক্কা মারতে গিয়ে জর্জ ডকরেলকে ক্যাচ দেন তিনি (২)৷
ভারত বিশ্বের যে প্রান্তেই খেলুক, সমর্থকরা ভরিয়ে তোলেন গ্যালারি৷ নিউইয়র্কের নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামেও এর ব্যতিক্রম হয়নি, গ্যালারি হয়ে উঠেছিল নীল সমুদ্র৷ শুধু স্টেডিয়াম কেন, খেলা দেখার ব্যবস্থা হয়েছিল নিউইয়র্ক শহরতলির বল্ডউইনের ডাউনটাউনের কালীমন্দিরেও৷
মন্দিরের উল্টো দিকের কমিউনিটি হলে জায়ান্ট স্ক্রিনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল ভারতের ম্যাচ দেখার জন্য৷ স্টেডিয়ামে টিকিট না পাওয়া অনেকেই ভিড় করেছেন সেখানে৷ ইনিংসের বিরতিতে সমর্থকদের ধন্যবাদও জানিয়েছেন হার্দিক পান্ডিয়া, ‘‘ভারতীয় দর্শকদের এমন সমর্থন অসাধারণ৷ বিশ্বজুড়েই ছড়িয়ে আছি আমরা, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা৷''
আয়ারল্যান্ড এমনিতে টি-টোয়েন্টির প্রতিষ্ঠিত এক দল৷ টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিয়ে ১১ নম্বরে থাকলেও বিশ্বকাপের ঠিক আগে খেলা ৩ ম্যাচের সিরিজের প্রথমটিতে তারা হারিয়েছিল পাকিস্তানকে৷ গত বিশ্বকাপে তারা হারিয়েছিল চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে৷
তবে ভারতের বিপক্ষে কখনও জয় পায়নি আয়ারল্যান্ড৷ হেরেছিল আগের ৭টিতেই৷ ব্যর্থতার বৃত্তটা ভেঙে আইরিশ রূপকথা হলো না আজও৷ ভারতীয় শাসনে তারা করল অসহায় আত্মসমর্পণ৷ আর র্যাঙ্কিয়ে এক নম্বরে থাকা রোহিত শর্মার দলের শুরুটা হলো ফেবারিটের মতই৷